ধর্ম ঠেকাতে আরেকজন বরকন্দাজের সন্ধান পাওয়া গেছে। আস্থাহীনতায় থাকা
নির্বাচন কমিশনের একজন কমিশনার মোঃ শাহনেওয়াজ বলেছেন, জাতীয় নির্বাচনে
ধর্মের অপব্যবহার করলে প্রয়োজনে প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করা হবে। তিনি
আরো বলেছেন, ধর্মের ব্যবহার করে নির্বাচনকে প্রভাবিত করা অপরাধ। এমন সময় এই
তত্ত্ব তিনি জাহির করলেন যখন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিশেষ করে সদ্য
সমাপ্ত গাজীপুর সিটি নির্বাচনে সরকার সমর্থিত প্রার্থী হেরে যাওয়ার পর তার
বিপর্যয়কর পরিণতির অন্যতম কারণ হিসাবে হেফাজতে ইসলামকে দায়ী করা হচ্ছে।
সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায়, শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের উপর
বর্বরোচিত নির্যাতন ও বুলেটের জবাব জনগণ ব্যালটে দিয়েছে। ফলে সরকারি এই
মনোভাবের রেকর্ডই ওই নির্বাচন কমিশনারের মুখে বেজেছে। বাস্তবতা হলো, যে
প্রার্থী তার নিজের পরাজয়ের জন্য হেফাজতে ইসলামীকে দায়ী করেছেন তিনি নিজেও
ভোট চাওয়ার সময় তার একদল সমর্থককে হেফাজতে ইসলামীর কর্মী বানিয়ে পরিচয়
করিয়ে দিয়েছেন। লক্ষ্যণীয় হচ্ছে, পাঁচ সিটি নির্বাচনে সরকার ও বাম জোট
সমর্থিত প্রার্থীদের শোচনীয় পরাজয়ের পর সরকার সমর্থিত তথাকথিত সুশীল সমাজের
প্রতিনিধি এক শ্রেণীর সাংস্কৃতিক কর্মী শাহবাগীদের মতোই অভিযোগ করতে শুরু
করেছে, হেফাজতে ইসলামী নির্বাচনী প্রচারণায় ধর্মের অপব্যবহার করেছে। ধর্মের
কথা বলাকে যদি অপব্যবহার হিসাবে আলোচ্য নির্বাচন কমিশনার বা অন্য কেউ মনে
করে থাকেন আর সেই কারণেই ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত হয়ে থাকেন তাহলে কার্যত তা
জাতীয় চেতনা ও বৈশিষ্ট্যের সাথে গাদ্দারী ছাড়া আর কিছুই নয়।
নিজের
ছায়াকে শত্রু বলে বিবেচনা করা যাদের রোগে পরিণত হয়েছে তাদের সত্য বোঝাবার
কোন সুযোগ নেই। বাংলাদেশের সমাজ বৈশিষ্ট্যে যেখানে ধর্ম একটি শক্তিশালী
অবস্থানে রয়েছে সেখানে নামাজ, রোজা, ধর্ম পালন বা চর্চার বিষয়টি আস্থায় না
নিয়ে এর বিপরীতে বা এর বিরুদ্ধে কথা বলা কতটা অসমীচীন হতে পারে এবং এর
পরিণতি কত মারাত্মক হতে পারে সংশ্লিষ্টরা বোধহয় তা বিবেচনায় আনেননি।
সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের কোন কোন মহল এবং সরকারের সমর্থনে কোন কোন গোষ্ঠী
যেভাবে দাড়ি-টুপি বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেছে তার কোন গ্রহণযোগ্যতা নেই।
আল্লাহ, রাসূল (স:) ও ইসলামের অবমাননা করে ব্লগ লেখার পরেও যখন এই অপরাধকে
জামিনযোগ্য মনে করা হয় তখন প্রশ্ন না উঠে পারে না। আলোচ্য নির্বাচন
কমিশনারের বক্তব্য থেকে তার প্রকৃত পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তোলাও অপ্রাসঙ্গিক
নয়। বোধ-বিশ্বাসের দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্যের কারণেই বর্তমান নির্বাচন কমিশন
সকল মহলের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়নি। কথার কপচানি যতই থাকুন না কেন, সিটি
নির্বাচনগুলোতে নির্বাচন কমিশন সততা, স্বচ্ছতা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে উঠতে
পারেনি। প্রধানবিরোধী দল নির্বাচন কমিশনকে সরকারি মদদপুষ্ট বলে অভিযোগ করে
আসছে। তার মতে, এই কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। চারটি সিটি
করপোরেশন নির্বাচনের দিনে প্রধান নির্বাচন কমিশনের দীর্ঘ অনুপস্থিতির রহস্য
এখনও উদঘাটিত হয়নি। ঐ নির্বাচনে কোন কোন ভোট কেন্দ্রে অনিয়মের গুরুতর
অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। বিরোধী প্রার্থীদের ব্যাপক জনসমর্থন না থাকলে
নির্বাচন কমিশনের উপেক্ষা অবহেলার কারণে তাদের মাঠে থাকাই কঠিন হয়ে পড়তো।
চাপের মুখে কিছু কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলেও কোন বিবেচনাতেই তা সুষ্ঠু
ব্যবস্থাপনা হিসাবে স্বীকৃতি পায়নি। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের রিপোর্টে
কিছু কিছু কেন্দ্রের অনিয়মের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ইলেকশন ওয়ার্কিং
গ্রুপের সদস্য ও জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদ (জানিপপ) তাদের
পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে নির্বাচনে রাজনৈতিক প্রভাবের কথা উল্লেখ করে বলেছে,
নির্বাচনে যে অমোচনীয় কালি ব্যবহার করা হয়েছে তা ছিল নি¤œমানের। বরিশাল ও
খুলনার কয়েকটি কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার উডবিউজের পর্যবেক্ষকদের ভোট
গণনা পর্যবেক্ষণ করতে দেয়নি। সিলেটে ভোট গণনা শেষে ফল প্রকাশে বিলম্বের
আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। এই নির্বাচন পূর্বকালে প্রশাসনের পক্ষপাতিত্বে পুলিশ
বাহিনীর শাসক দল সমর্থিত প্রার্থীর প্রতি নমনীয় ও বিরোধী দল সমর্থিত
প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের উপর মারমুখী হলেও নির্বাচন কমিশন ছিল নির্বিকার।
সর্বশেষ গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও কোন কোন কেন্দ্রে সরকার দলীয়
প্রার্থীদের এককভাবে ভোট দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। বিরোধী দলীয় প্রার্থীর
সমর্থকদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে কিছু কিছু ব্যবস্থা নেয়ার কথা নির্বাচনের
দায়িত্বশীলরাও স্বীকার করেছেন। ফলাফল দর্শনে নির্বাচন কমিশনের কারো কারো
হতাশা ও ক্ষুব্ধতা যে চরমে উঠেছে তা অনুমান করা যায়। নয়তো রাজনৈতিক দলগুলোর
মধ্যে ঐকমত্য থাকার পরেও নির্বাচন কমিশন ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে আইন
সংশোধন করতে যাচ্ছে বলে মো: শাহনেওয়াজ উল্লেখ করবেন কেন?
নির্বাচনে
প্রার্থীদের ধর্মীয় সংস্কৃতি চর্চা সম্পর্কে কমিশনার মো: শাহনেওয়াজ যা
বলেছেন, এটা ঔদ্ধ্যত্বপূর্ণ। সম্প্রতি সরকার ইসলাম ও মুসলমান বিদ্বেষী এমন
কিছু গর্হিত কর্ম করেছে যা প্রকাশ হবার ভয় থেকেই তা বন্ধ রাখতে নানা
অজুহাতের আশ্রয় নেয়া হচ্ছে। নির্বাচন কমিশন বা সরকারি মহল যা বলছে বা বলতে
চাইছে তা খোড়া যুক্তি। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশে প্রতিটি কর্মকা-ে
ধর্মীয় প্রভাব থাকবে এটাই স্বাভাবিক। একে নিবৃত্ত করতে চাওয়ার অর্থ হচ্ছে,
মূল্যবোধ ভিত্তিক দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না দেয়ার পটভূমি রচনা
করা। কমিশনের এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে পক্ষপাতিত্বের গুরুতর অভিযোগই
প্রমাণিত হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের প্রধান কাজ, সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা
করা। সে কাজে মনোনিবেশ না করে জাতিকে শিক্ষা দিতে এত উৎসাহ দেখানো নির্বাচন
কমিশন বা কোন কমিশনারের উচিৎ নয়। এই প্রবণতা অগ্রহণযোগ্য। ভবিষতে এ রকম
বক্তব্য রাখা থেকে নির্বাচন কমিশন ও কমিশনাররা বিরত থাকবে বলে আমরা আশা
করি।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন