বাইতুল হিকমাহ
উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
এই নিবন্ধটির একটা বড়সড় অংশ কিংবা সম্পূর্ণ অংশই একটিমাত্র সূত্রের উপর নির্ভরশীল। অনুগ্রহ করে নিবন্ধটির উন্নয়নে বাড়তি তথ্যসূত্রদিয়ে সহায়তা করুন। একটিমাত্র সূত্র ব্যবহারের ব্যাপারে আলোচনা আলাপ পাতায় পাওয়া যেতে পারে। (June 2014) |
- এই নিবন্ধটি আব্বাসীয় খিলাফতের সময় বাগদাদের গ্রন্থাগার সম্পর্কিত।
- প্রাচীন ফাতেমীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য দেখুন দারুল হিকমাহ।
বাইতুল হিকমাহ (আরবি: بيت الحكمة; Bayt al-Hikma) ছিল আব্বাসীয় আমলে ইরাকের বাগদাদে প্রতিষ্ঠিত একটি গ্রন্থাগার, অনুবাদকেন্দ্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।[১] এটিকে ইসলামি স্বর্ণযুগের একটি প্রধান বুদ্ধিবৃত্তিক কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাইতুল হিকমাহ খলিফা হারুনুর রশিদ (শাসনকাল ৭৮৬-৮০৯ খ্রিষ্টাব্দ) প্রতিষ্ঠা করেন এবং তার পুত্র আল মামুন (শাসনকাল ৮১৩-৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দ) এর সময় তা সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌছায়। জ্ঞানের আদানপ্রদানের জন্য আল মামুন অনেক জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিকে বাইতুল হিকমাহতে নিয়ে আসেন। ৯ম থেকে ১৩ শতক পর্যন্ত পারসিয়ান ও খ্রিষ্টানসহ[২] অসংখ্য পন্ডিত ব্যক্তি এই গবেষণা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত ছিলেন। আরবিতে গ্রন্থ অনুবাদ ও সংরক্ষণের পাশাপাশি পন্ডিতরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে মৌলিক অবদান রাখেন।[৩][৪]
আল মামুনের শাসনামলে মানমন্দির স্থাপিত হয়। এসময় এই প্রতিষ্ঠানটি গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসাবিজ্ঞান, আলকেমি, প্রাণিবিদ্যা,ভূগোল ও মানচিত্রাঙ্কনবিদ্যাসহ বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানচর্চার অপ্রতিদ্বন্দ্বী স্থান হয়ে উঠে। ভারতীয়, গ্রীক ও পারসিয়ান রচনা ব্যবহার করে পন্ডিতরা বৈশ্বিক জ্ঞানের বিরাট ভান্ডার অর্জন করেন এবং এর মাধ্যমে তাদের নিজেদের আবিষ্কারের দিকে এগিয়ে যান। নবম শতকের মধ্যভাগে বাইতুল হিকমাহ ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ গ্রন্থভান্ডার।[৪]
মোঙ্গলদের বাগদাদ অবরোধের সময় শহরের পতন হলে এই গ্রন্থাগারটিও ধ্বংস হয়ে যায়।
পরিচ্ছেদসমূহ
[আড়ালে রাখো]ইতিহাস[সম্পাদনা]
ভিত্তিস্থাপন ও সূচনা[সম্পাদনা]
মানব জ্ঞানের সংরক্ষণ বাইজেন্টাইন ও পারসিয়ানদের উল্লেখযোগ্য প্রথা ছিল।[৫] চতুর্থ থেকে সপ্তম শতকে গ্রীক ও সিরিয়াক ভাষার পাণ্ডিত্যপূর্ণ রচনাগুলো নতুন করে শুরু হয় বা হেলেনিয় যুগ থেকে জারি রাখা হয়। জ্ঞানচর্চা ও আদানপ্রদানের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ছিল। এগুলোর মধ্যে ছিল, স্কুল অব নিসিবিস ও পরবর্তীতে স্কুল অব এডেসা, সেসাথে জুন্দশাপুরের মেডিকেল একাডেমি। গ্রন্থাগারের মধ্যে ছিলআলেক্সান্দ্রিয়ার প্রাচীন গ্রন্থাগার ও কনস্টান্টিনোপলের রাজকীয় গ্রন্থাগার এবং অনুবাদ ও শিক্ষালাভের অন্যান্য কেন্দ্র যা মার্ভ,সেলোনিকা, নিশাপুর ও তিসফুনে অবস্থিত ছিল।.[৬][৭]
উমাইয়া খলিফা প্রথম মুয়াবিয়া দামেস্কে বইয়ের একটি সংগ্রহ গড়ে তোলেন। এটিকে ইতিমধ্যেই বাইতুল হিকমাহ বলা হত।[৪] এতে চিকিৎসা, আলকেমি ও অন্যান্য বিষয়ের উপর গ্রীক ও খ্রিষ্টান উৎসের গ্রন্থ ছিল।[৮] উমাইয়ারা চৈনিকদের কাছ থেকে কাগজ তৈরীর প্রক্রিয়া রপ্ত করে। তারা নিজেদের অধীনে অনেক বুদ্ধিবৃত্তিক কেন্দ্র সৃষ্ট করে ও খ্রিষ্টান ও পারসিয়ান পন্ডিতদের আরবিতে অনুবাদ ও নতুন জ্ঞান সৃষ্টির জন্য নিয়োগ দেয়।[৯] আরব বিশ্বে জ্ঞানের উন্মেষের জন্য এসব ঘটনা ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।[৮]
৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে আব্বাসীয়রা উমাইয়াদের হটিয়ে মুসলিম বিশ্বে শাসন শুরু করে। ৭৬২ তে খলিফা আল মনসুর (শাসনকাল ৭৫৪-৭৭৫ খ্রিষ্টাব্দ) রাজধানী হিসেবে বাগদাদ নগরী গড়ে তোলেন। পূর্বে দামেস্ক রাজধানী ছিল। বাগদাদের স্থান ও এর বহুজাতিক জনগোষ্ঠী বাণিজ্য ও বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের জন্য সুসংহত কেন্দ্র গড়ে তোলে।[৮] আব্বাসীয় রাজবংশের পারসিয়ানদের প্রতি ঝোক ছিল।[১০] তারা সাসানীয় সাম্রাজ্যের অনেক প্রথা গ্রহণ করে। এর মধ্যে বিদেশি ভাষার রচনা অনুবাদও অন্তর্ভুক্ত ছিল। পার্থক্য ছিল এই যে এসময় গ্রন্থ আরবিতে অনুবাদ হত। এ উদ্দেশ্যে আল মনসুর সাসানীয় রাজকীয় গ্রন্থাগারের আদলে একটি প্রাসাদ গ্রন্থাগার গড়ে তোলেন এবং কর্মরত বুদ্ধিজীবীদের আর্থিক ও রাজনৈতিক সমর্থন প্রদান করেন। তিনি ভারত ও অন্যান্য স্থান থেকে জ্ঞানের আদানপ্রদানের জন্য পন্ডিতদের দলকে নবীন আব্বাসীয় দরবারে আমন্ত্রণ জানান।[৮]
আব্বাসীয় আমলে গ্রীক, চৈনিক, সংস্কৃত ও সিরিয়াক ভাষা থেকে অসংখ্য গ্রন্থ আরবিতে অনুদিত হয়। অনুবাদ আন্দোলন খলিফা হারুনুর রশিদের সময় ব্যাপক আকার লাভ করে। পূর্বসূরির মত তিনিও জ্ঞানচর্চার অনুগামী ছিলেন।[৪] রচনাগুলো মূলত চিকিৎসাবিজ্ঞান, গনিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক হলেও অন্যান্য শাখা যেমন দর্শনও দ্রুত এতে যুক্ত হয়। হারুনুর রশিদের গ্রন্থাগার যা বাইতুল হিকমাহের পূর্বসূরি ছিল সেটিও বাইতুল হিকমাহ বলে পরিচিত ছিল। ইতিহাসবিদ আল কিফতি এটির নাম দেন, খিজানাত কুতুবুল হিকমাহ (আরবিতে অর্থ "জ্ঞানগ্রন্থের ভান্ডার")।[৪]
আল মামুনের শাসনামল[সম্পাদনা]
খলিফা আল মামুনের পৃষ্ঠপোষকতায় বাইতুল হিকমাহর অর্থনৈতিক সুবিধা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। অধিকন্তু আব্বাসীয় সমাজ জ্ঞানের গুরুত্ব বুঝতে পারে এবং এর পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে আসে। বণিকশ্রেণী ও সামরিক বাহিনীও এতে সাহায্য করে।[৮] পন্ডিত ও অনুবাদকদের জন্য এখানে জীবনধারণ করা সম্মানের বিষয়ে পরিণত হয়।[৪] এমনকি অন্যান্য ধনসম্পদের তুলনায় যুদ্ধলব্ধ সম্পদ হিসেবে বই অধিক কাঙ্খিত হয়ে উঠে।[৪] এমনকি আব্বাসীয় ও বাইজেন্টাইনদের মধ্যে একটি যুদ্ধের পর শান্তির শর্ত হিসেবে টলেমির আলমাজেস্ট দাবি করা হয়।[১১]
বাইতুল হিকমাহ একটি একাডেমিক কেন্দ্রের চেয়েও বেশি হিসেবে কাজ করে। এর বিশেষজ্ঞরা বাগদাদে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখেন। পন্ডিতরা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্যকর্মে স্থপতি ও প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করতেন। তারা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সরকারি দিনপঞ্জির হিসাব রাখেন এবং সরকারি কর্মী হিসেবে কাজ করেন। তারা একইসাথে চিকিৎসক ও পরামর্শদাতাও ছিলেন।[৪][৮]
আল মামুন ব্যক্তিগতভাবে বাইতুল হিকমাহর দৈনন্দির কাজে জড়িত ছিলেন। তিনি নিয়মিতভাবে এর পন্ডিতদের সাথে সাক্ষাত করতেন এবং খোজখবর নিতেন। তিনি বিভিন্ন একাডেমিক বিতর্কে অংশগ্রহণ করতেন।[৮] অধিকন্তু তিনি তার ব্যক্তিগত প্রয়োজনে বাইতুল হিকমাহর পন্ডিতদের বিভিন্ন দলগঠন করতেন। উদাহরণস্বরূপ, তিনি পৃথিবীর মানচিত্রের, আলমাজেস্টের তথ্যের সঠিকতা ও পৃথিবীর সঠিক আকারের ব্যাপারে আদেশ প্রদান করেন। তিনি মিশর বিষয়ক গবেষণাকেও উতসাহিত করেন এবং ব্যক্তিগতভাবে পিরামিডের খননে অংশ নেন।[৪]
তার পূর্বসূরির অনুকরণে আল মামুন বিদেশে জ্ঞান সংক্রান্ত রচনার অনুসন্ধানে বাইতুল হিকমাহর পন্ডিতদের প্রেরণ করেন। এমনকি এর একজন পরিচালককে কনস্টান্টিনোপল এ উদ্দেশ্যে প্রেরণ করা হয়। তার সময় সাহল ইবনে হারুন নামক পারসিয়ান কবি ও জোতিষবিদ বাইতুল হিকমাহর প্রধান গ্রন্থগারিক ছিলেন। হুনায়ন ইবনে ইসহাক (৮০৯-৮৭৩) নামক এসিরিয়ান নেস্টোরিয়ান খ্রিষ্টান চিকিৎসক ও বিজ্ঞানী ছিলেন সবচেয়ে দক্ষ অনুবাদক যিনি ১১৬টি গ্রন্থ আরবিতে অনুবাদ করেন। অনুবাদের পন্ডিত হিসেবে খলিফা তাকে নিজের জন্য অনুবাদের দায়িত্ব দেন। সাবিত ইবনে কুরা (৮২৬-৯০১) আপোলোনিয়াস,আর্কিমিডিস, ইউক্লিড ও টলেমির গুরুত্বপূর্ণ রচনা অনুবাদ করেন। নতুন আব্বাসীয় বৈজ্ঞানিক প্রথায় উন্নতমানের অনুবাদের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়ায় এ সময়ের অনুবাদগুলো পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় উন্নততর ছিল। সেসাথে নতুন ধারণা গড়ে তোলার জন্যও গুরুত্ব প্রদান করা হয়।[৮]
নবম শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাইতুল হিকমাহ এসময়ের সর্ববৃহৎ বইয়ের ভান্ডারে এবং মধ্যযুগের অন্যতম প্রধান বুদ্ধিবৃত্তিক কেন্দ্রে পরিণত হয়। অসংখ্য আরব ও পারসিয়ান মেধাবী ব্যক্তি এতে আকৃষ্ট হয়। বাইতুল হিকমাহ জ্ঞানচর্চার জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠে। তবে এসময় বিশ্ববিদ্যালয় ধাচের প্রতিষ্ঠান ছিল না। প্রতিষ্ঠান ছাড়া সরাসরি শিক্ষক থেকে ছাত্রদের মধ্যে জ্ঞানের প্রবাহ ঘটত। ৯ম শতক থেকে মক্তব নামক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে থাকে এবং ১১ শতকে নিজামুল মুলক নিজামিয়া মাদ্রাসা নামক মাদ্রাসা গড়ে তোলেন যা ইরাকের অন্যতম প্রাচীন উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল।
পতন ও মোঙ্গলদের কর্তৃক ধ্বংসসাধন[সম্পাদনা]
আল মামুনের উত্তরাধিকারি আল মুতাসিম (শাসনকাল ৮৩৩-৮৪২) ও তার পুত্র আল ওয়াসিকের অধীনে বাইতুল হিকমাহ সৌকর্য বজায় রাখে। কিন্তু আল মুতাওয়াক্কিলের আমলে (শাসনকাল ৮৪৭-৮৬১) এর অবনতি শুরু হয়।[১২] আল মামুন, আল মুতাসিম ও আল ওয়াসিক বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের সমর্থকমুতাজিলা মতকে অনুসরণ করলেও আল মুতাওয়াক্কিল কুরআন ও হাদিস থেকে ব্যাখ্যার উপর অধিক জোর দেন।[১২] খলিফা বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী ছিলেন না। তিনি গ্রীক দর্শনকে ইসলামের বিপক্ষ হিসেবে দেখতেন।[১২]
বাগদাদের অন্যান্য গ্রন্থাগারের সাথে বাইতুল হিকমাহও হুলাগু খান কর্তৃক বাগদাদ অবরোধের সময় ধ্বংস হয়ে যায়।[১৩] নাসিরুদিন আল তুসি প্রায় ৪০,০০০ এর মত পান্ডুলিপি রক্ষা করতে সক্ষম হন যা তিনি অবরোধের পূর্বে মারাগেহ নিয়ে যান।[১৪]
মোঙ্গল আক্রমণকে আরব বিজ্ঞানের সমাপ্তির জন্য দায়ী করা হলেও ১৩ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাগদাদ আব্বাসীয় খিলাফতের একমাত্র জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র ছিল না। তাই বাইতুল হিকমাহর ক্ষয়প্রাপ্তিকে আরব জ্ঞানচর্চা পতনের কারণ হিসেবে ধরা যায় না।[১৩]
মূল কর্মকাণ্ড[সম্পাদনা]
বাইতুল হিকমাহতে বিজ্ঞানী ও পন্ডিতদের দল ছিল। সেসাথে ছিল অনুবাদ কেন্দ্র ও গ্রন্থাগার যা শতাব্দীকাল যাবত সংগৃহীত জ্ঞানের রক্ষণাবেক্ষণের স্থান।[৮] অধিকন্তু, মানমন্দির ও অন্যান্য পরীক্ষা নিরীক্ষার উপায় অবলম্বন করা হয়।[৪] প্রকৃতপক্ষে এটি শুধু একটি গ্রন্থাগারের চেয়েও বেশি কিছু ছিল। উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক কর্ম পন্ডিতরা এখানে সৃষ্টি করেন।[৪]
অনুবাদ[সম্পাদনা]
দেড়শত বছর যাবত সহজলভ্য গ্রীক ভাষার সকল বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক কর্ম অনুবাদ করা হয়।[১৫][১৬] এরিস্টটলের টপিক গ্রন্থের মাধ্যমে অনুবাদ শুরু হয়। আল মামুনের সময় অনুবাদকরা শুধুমাত্র পারসিয়ান জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত লেখা থেকে সরে আসেন এবং গ্রিক কাজগুলো ইতিমধ্যে তাদের তৃতীয় অনুবাদ ছিল।পিথাগোরাস, প্লেটো, এরিস্টটল, হিপোক্রেটিস, ইউক্লিড, প্লটিনাস, গ্যালন, চরক, আর্যভট্ট ও ব্রহ্মগুপ্তের লেখা অনুবাদ করা হয়।
অধিকন্তু নতুন আবিষ্কার অনুবাদের পরীক্ষাকে উতসাহিত করে। ফলে প্রাচীন লেখা কিছু ক্ষেত্রে সংশোধন করা হয় বা নতুন তথ্য যোগ করা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে নাম ও পরিভাষা বদলানো হয়। এর মধ্যে অন্যতম হল টলেমির আলমাজেস্ট যা ছিল মূল কর্ম মেগালে সিনটেক্সিস এর আরবিরূপ।[৮]
মৌলিক অবদান[সম্পাদনা]
অনুবাদের পাশাপাশি পণ্ডিতরা গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক গবেষণা পরিচালনা করেন। উদাহরণস্বরূপ, বিখ্যাত গণিতবিদআল খোয়ারিজমি বাইতুল হিকমাহতে কর্মরত থাকার সময় বীজগণিতের উপর ব্যাপক অবদান রাখেন।[৪] তিনি তার গ্রন্থ কিতাবুল জাবরের জন্য বিখ্যাত। এতে তিনি বেশ কিছু এলগরিদম উদ্ভাবন করেন।[৪] “এলজেবরা” ও ‘’এলগরিদম” শব্দ দুটি আল খোয়ারিজমির সাথে সম্পর্কিত। এর পাশাপাশি, তিনি আরব জগতে হিন্দু সংখ্যা পদ্ধতির প্রচলন ঘটান। পরে তা ইউরোপে পৌছায়। আল কিন্দি তথ্যের গোপনীয়তা বিষয়ক ক্রিপোটোগ্রাফি নিয়ে কাজ করেন।[৪]
এছাড়াও জ্যোতির্বিজ্ঞান ও পদার্থবিজ্ঞানে অনেক মৌলিক গবেষণা হয়। মুহাম্মদ জাফর ইবনে মুসা মুহাম্মদ মুসাপদার্থবিজ্ঞানের সূত্রের বিশ্বজনীনতার কথা প্রথম বলেন। পরবর্তীতে ১০ শতকে আল হাসান বিশেষত আলোকবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বেশ কিছু পরীক্ষার সম্পাদন করেন। তার এসকল অর্জন এখনও ব্যবহৃত হচ্ছে।[১৭]
মুহাম্মদ মুসা ও তার ভ্রাতৃদ্বয় আহমেদ ইবনে মুসা ও হাসান ইবনে মুসা (তাদের একসাথে বনু মুসা বলা হয়) ছিলেন দক্ষ প্রকৌশলী। তারা কিতাবুল হিয়াল নামক যন্ত্র সংক্রান্ত গ্রন্থ লেখেন। এতে একশতেরও বেশি বর্ণনা ও সেগুলোর ব্যবহারবিধি ছিল। এর মধ্যে ছিল একটি “স্বয়ংক্রিয়ভাবে খেলতে সক্ষম যন্ত্র”। এটি প্রোগ্রাম করা যন্ত্রের সর্বপ্রাচীন উদাহরণ।[১৮]
চিকিৎসাবিজ্ঞানে হুনায়ন ইবনে ইসহাক চক্ষুরোগ নিয়ে আলোচনা করেন। অন্যান্য পন্ডিতরা গুটিবসন্ত, সংক্রমণ ও অস্ত্রোপচার বিষয়ে লিখেছেন। এসকল গ্রন্থ পরবর্তীতে রেনেসার সময় চিকিতসাশাস্ত্রের আদর্শ পাঠ্যপুস্তকে পরিণত হয়।[১৯]
আল মামুনের শাসনের সময় বিজ্ঞান সর্বপ্রথম ব্যাপকাকারে গবেষণা প্রত্যক্ষ করে।[২০] টলেমির পর্যবেক্ষণ পরীক্ষা করার জন্য খলিফা বাগদাদে প্রথম মানমন্দির নির্মাণের আদেশ দেন। টলেমির তথ্যউপাত্তগুলো পরীক্ষা করে দেখা হয় এবং দক্ষ ভূগোলবিদ, গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা তার পুনর্নির্মাণ করেন।[৮] আল মামুন পৃথিবীর পরিধি নির্ণয়ের জন্য গবেষণা সংগঠিত করেন। ভূগোলে তার প্রচেষ্টার মাধ্যমে পৃথিবীর প্রথম বিস্তারিত মানচিত্র তৈরি করা হয়। অনেকের মতে এই প্রচেষ্টাগুলো পৃথিবীর প্রথম রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গবেষণাকর্ম।[২০]
মানমন্দির[সম্পাদনা]
ইসলামি জগতে প্রথম মানমন্দির খলিফা আল মামুনের আদেশে ৮২৮ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত হয়। এর নির্মাণে বাইতুল হিকমাহর পন্ডিতরা সরাসরি কাজ করেন।[২১]এটি আল শামাসিয়ায় অবস্থিত ছিল এবং একে মুমতাহান মানমন্দির বলা হত। সূর্য, চাঁদ ও অন্যান্য গ্রহের পর্যবেক্ষণের পর দ্বিতীয় একটি মানমন্দির দামেস্কের কাছে কাসিউন পর্বতের উপর স্থাপন করা হয়। এসব পরিশ্রমলব্ধ ফলাফল ‘’আল জিজ আল মুমতাহান’’ নামক গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়।[২০][২২]
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ[সম্পাদনা]
বাইতুল হিকমাহর সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের তালিকা নিম্নে দেয়া হল। অধিকাংশের নাম উপরে দেয়া আছে। তালিকায় উল্লেখিত পেশা ছাড়াও তাদের অধিকাংশ অনুবাদক ছিলেন:
- সাহল ইবনে হারুন (মৃত্যু ৮৩০), প্রধান গ্রন্থগারিক;
- হুনায়ন ইবনে ইসহাক (৮০৯-৮৭৩), চিকিৎসক;
- ইয়াকুব ইবনে ইসহাক আল কিন্দি, (৮০১-৮৭৩), দার্শনিক ও পলিমেথ;
- আল খোয়ারিজমি, মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল খোয়ারিজমি, (৭৮০-৮৫০), গনিতবিদ;
- বনু মুসা ভ্রাতৃবৃন্দ, প্রকৌশলী ও গনিতবিদ;
- সিন্দ ইবনে আলি (মৃত্যু ৮৬৪), জ্যোতির্বিজ্ঞানী;
- আবু উসমান, সাধারণত আল জাহিজ নামে পরিচিত (৭৮১-৮৬১), লেখক ও জীববিজ্ঞানী;
- আল জাজারি (১১৩৬-১২০৬), চিকিৎসক ও প্রকৌশলী।
একইরকম অন্যান্য প্রতিষ্ঠান[সম্পাদনা]
অন্যান্য কিছু স্থানেও বাইতুল হিকমাহ বলে অবিহিত প্রতিষ্ঠান ছিল:
- কায়রোতে দারুল হিকমাহ নামে একটি প্রতিষ্ঠান ছিল যা অন্য নাম ছিল বাইতুল হিকমাহ। এটি ফাতেমীয় খলিফা আল হাকিম বি আমরিল্লাহ ১০০৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন।[৪]
- আব্বাসীয় আমলের বাইতুল হিকমাহর নামে বাগদাদে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ছিল। এর কমপ্লেক্সের মধ্যে ১৩ শতকের একটি মাদ্রাসা ছিল। তবে এটি মধ্যযুগের বাইতুল হিকমাহর মত হুবহু ছিল না। ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে ইরাক আক্রমণের সময় এটি ধ্বংস হয়ে যায়।৩৩.৩৪২৩° উত্তর ৪৪.৩৮৩৬° পূর্ব
- করাচিতে অবস্থিত হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান গ্রন্থাগারের নাম বাইতুল হিকমাহ।
আরও দেখুন[সম্পাদনা]
- বাগদাদের বৃত্তাকার শহর
- ইখওয়ানুস সাফা
- দারুল হিকমাহ
- দারুল হিকমাহ কলেজ
- মধ্যযুগের ইসলামে জ্যোতির্বিজ্ঞান
তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]
- ↑ [১], Encyclopædia Britannica
- ↑ Hyman and Walsh Philosophy in the Middle Ages Indianapolis, 1973, p. 204' Meri, Josef W. and Jere L. Bacharach, Editors, Medieval Islamic Civilization Vol.1, A - K, Index, 2006, p. 304.
- ↑ Meri, p. 451.
- ↑ ৪.০০৪.০১ ৪.০২ ৪.০৩ ৪.০৪ ৪.০৫ ৪.০৬ ৪.০৭ ৪.০৮ ৪.০৯ ৪.১০ ৪.১১ ৪.১২ ৪.১৩ ৪.১৪ Al-Khalili, pp. 67-78
- ↑ Ferguson, Kitty Pythagoras: His Lives and the Legacy of a Rational Universe Walker Publishing Company, New York, 2008, (page number not available – occurs toward end of Chapter 13, “The Wrap-up of Antiquity”). “It was in the Near and Middle East and North Africa that the old traditions of teaching and learning continued, and where Christian scholars were carefully preserving ancient texts and knowledge of the ancient Greek language.”
- ↑ Kaser, Karl The Balkans and the Near East: Introduction to a Shared History p. 135.
- ↑ Yazberdiyev, Dr. Almaz Libraries of Ancient Merv Dr. Yazberdiyev is Director of the Library of the Academy of Sciences of Turkmenistan, Ashgabat.
- ↑ ৮.০০৮.০১ ৮.০২ ৮.০৩ ৮.০৪ ৮.০৫ ৮.০৬ ৮.০৭ ৮.০৮ ৮.০৯ ৮.১০ Lyons, pp. 55-77
- ↑ Meri, Josef W. and Jere L. Bacharach. “Medieval Islamic Civilization”. Vol. 1 Index A – K. 2006, p. 304.
- ↑ Wiet. Baghdad
- ↑ Angelo, Joseph (2009)। Encyclopedia of Space and Astronomy। পৃ: 78।আইএসবিএন 9781438110189।
- ↑ ১২.০১২.১ ১২.২ Al-Khalili, p. 135
- ↑ ১৩.০১৩.১ Al-Khalili, p. 233
- ↑ Saliba, p.243
- ↑ Rosenthal, Franz The Classical Heritage in Islam The University of California Press, Berkely and Los Angeles, 1975, p. 6
- ↑ Adamson, London Peter The Great Medieval Thinkers: Al-Kindi Oxford University Press, New York, 2007, p. 6. London Peter Adamson is a Lecturer in Late Ancient Philosophy at King's College.
- ↑ Al-Khalili, pp. 152-171
- ↑ Koetsier
- ↑ Moore
- ↑ ২০.০২০.১ ২০.২ Al-Khalili, pp. 79-92
- ↑ Hockey 1249
- ↑ Zaimeche, p. 2
দেখুন[সম্পাদনা]
- Al-Khalili, Jim (2011), The House of Wisdom: How Arabic Science Saved Ancient Knowledge and Gave Us the Renaissance, New York: Penguin Press,আইএসবিএন 9781594202797
- Lyons, Jonathan (2009), The House of Wisdom: How the Arabs Transformed Western Civilization, New York: Bloomsbury Press, আইএসবিএন 9781596914599
- Meri, Joseph; Bacharach, Jere (2006), Medieval Islamic Civilization: An Encyclopedia, Routledge, আইএসবিএন 0415966906
- Hockey, Thomas (2007), The Biographical Encyclopedia of Astronomers, New York: Springer, আইএসবিএন 9780387304007
- Koetsier, Teun (2001), "On the prehistory of programmable machines: musical automata, looms, calculators", Mechanism and Machine Theory (Elsevier) 36 (5): 589–603,ডিওআই:10.1016/S0094-114X(01)00005-2.
- Micheau, Francoise, "The Scientific Institutions in the Medieval Near East", in (Morelon & Rashed 1996, পৃ. 985–1007)
- Moore, Wendy (February 28, 2011), "All the world’s knowledge", BMJ 342, ডিওআই:10.1136/bmj.d1272
- Morelon, Régis; Rashed, Roshdi (1996), Encyclopedia of the History of Arabic Science 3, Routledge, আইএসবিএন 0415124107
- George Saliba, 'Islamic science and the making of the European Renaissance',
- Zaimeche, Salah (2002), "A cursory review of Muslim observatories", Foundation for Science, Technology and Civilisation, Manchester
|
- Articles needing additional references from June 2014
- All articles needing additional references
- আরবি ভাষার লেখা রয়েছে এমন নিবন্ধ
- ৯ম-শতকে প্রতিষ্ঠিত
- বাগদাদের দালান ও কাঠামো
- ধ্বংসপ্রাপ্ত গ্রন্থাগার
- আব্বাসীয় খিলাফতের অধীন বাগদাদ
- ৮ম শতকে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
- ইসলামি বিজ্ঞানের ইতিহাস
- আরবি স্থাপত্য
- ইরাকের গ্রন্থাগার
- ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থান
- হারুনুর রশিদ
- অনুবাদ প্রতিষ্ঠান
- অনুবাদের ইতিহাস
- ৮ম শতকে ইরাক
- ৯ম শতকে ইরাক
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন