কেন ইস্তিখারা করবো? --১ম পর্ব
প্রত্যেক মুসলিমের জন্য খুব ই গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল। সকলেই করার চেষ্টা করি।
ইসতিখারার সুন্নত তরিকা
ইসতিখারার সুন্নত তরিকা
মূলঃ আল্লামা মুফতি তাকি উসমানি
হামদ এবং সালাতের পর…
قال عبد الله بن عمر : إن الرجل ليستخير الله فيختار له ، فيسخط على ربه ، فلا يلبث أن ينظر في العاقبة فإذا هو قد خار له
হাদিসটির উদ্দেশ্য
উপরিউক্ত বর্ণনাটি আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. এর উক্তি।[1] তিনি বলছেন, অনেক সময় মানুষ আল্লাহ তাআলার কাছে ইসতিখারা করে— আমার জন্য যে বিষয়টি কল্যাণকর, তা-ই যেনো হয়। তখন আল্লাহ তাআলা তার জন্য সে বিষয়ের ফায়সালা করেন, যা তার জন্য কল্যাণকর। বাহ্যদৃষ্টিতে অনেক সময় বান্দার কাছে ফায়সালাকৃত বিষয়টির কল্যাণ ও যথার্থতা বোধগম্য হয় না। তখন সেই বান্দা নিজ প্রতিপালকের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে যায়। সে তখন মন্তব্য করে বসে, আমি তো আল্লাহকে এ কথা বলেছিলাম যে, আমার জন্য কল্যাণকর বিষয় স্থির করে দিন। এখন নসিবে যা জুটলো, তা তো আমার কাছে ভালো মনে হচ্ছে না। উপরন্তু এতে তো আমার জন্য আরো কষ্ট এবং পেরেশানি। এরপর কিছুকাল পরে যখন পরিণতি সামনে আসে, তখন তার বোধগম্য হয় যে, আল্লাহ তাআলা তার জন্য যে ফায়সালা করেছিলেন, সেটাই তার ক্ষেত্রে উত্তম এবং কল্যাণকর ছিলো। প্রথমে বিষয়টি তার বোধগম্য হয়নি। তখন সে ভেবেছে, আমার প্রতি জুলুম এবং অন্যায় করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলার ফায়সালার যথার্থতা কখনো দুনিয়ায় প্রকাশিত হয় আর কখনো তার যথার্থতা দুনিয়ায় প্রকাশিত হয় না। এই অপ্রকাশিত বিষয়ও ইনশাআল্লাহ তা আখিরাতে প্রকাশ পাবে।
এই বর্ণনার আলোকে কয়েকটি বিষয় আলোচনার দাবি রাখে, যে বিষয়গুলো ভালো করে বুঝে নেয়া উচিত। প্রথম কথা হলো, কোনো বান্দা যখন আল্লাহ তাআলার কাছে ইসতিখারা করে, তখন আল্লাহ তাআলা তার জন্য কল্যাণের ফায়সালা করে দেন। ইসতিখারা কাকে বলে? এ বিষয়ে সমাজে বিভিন্ন ধরনের বিভ্রান্তি পরিলক্ষিত হয়। সাধারণভাবে অধিকাংশ মানুষের ধারণা, ইসতিখারা করার জন্য নির্দিষ্ট তরিকা এবং নির্দিষ্ট আমল রয়েছে। নির্দিষ্ট পন্থায় ইসতিখারা করা হলে এরপর কোনো স্বপ্ন দেখা যায়। সেই স্বপ্নে নির্দেশনা দিয়ে দেয়া হয়, অমুক কাজ করো কিবা তা করা থেকে বিরত থাকো। খুব ভালো করে বুঝে নিন, রাসুলুল্লাহ সা. এর থেকে ইসতিখারার যে সুন্নত তরিকা প্রমাণিত রয়েছে, তার মধ্যে এ ধরনের কোনো বিষয়ই নেই।
ইসতিখারার তরিকা এবং তার দোয়া
ইসতিখারার সুন্নত তরিকা হলো, ইসতিখারার নিয়তে দু’রাকাত নফল নামাজ পড়া হবে। নিয়ত এভাবে করবে, আমার সামনে দুটো পথ খোলা রয়েছে। এ দুটোর মাঝে আমার জন্য যেটা কল্যাণকর হবে, আল্লাহ তাআলা তার ফায়সালা করে দিন। এরপর দু’রাকাত নামাজ পড়বে। নামাজের পরে রাসুলুল্লাহ সা. থেকে নির্দেশিত দোয়া পাঠ করবে। এ এক বড় আশ্চর্যজনক দোয়া। এমন দোয়া শুধু নবির পক্ষেই করা সম্ভব। অন্য কারো সাধ্য নেই এমন অভিনব দোয়া তৈরি করা। যতোই চেষ্টা করা হোক, কিছুতেই এমন দোয়া করা কোনো সাধারণ মানুষের পক্ষে করা সম্ভব নয়— যা নবিজি সা. তার উম্মতকে শিখিয়ে গেছেন। দোয়াটি নিম্নরূপ—
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْتَخِيرُكَ بِعِلْمِكَ وَأَسْتَقْدِرُكَ بِقُدْرَتِكَ وَأَسْأَلُكَ مِنْ فَضْلِكَ الْعَظِيمِ فَإِنَّكَ تَقْدِرُ وَلَا أَقْدِرُ وَتَعْلَمُ وَلَا أَعْلَمُ وَأَنْتَ عَلَّامُ الْغُيُوبِ اللَّهُمَّ إِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ هَذَا الْأَمْرَ خَيْرٌ لِي فِي دِينِي وَمَعَاشِي وَعَاقِبَةِ أَمْرِي فَاقْدِرْهُ لِي وَيَسِّرْهُ لِي ثُمَّ بَارِكْ لِي فِيهِ وَإِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ هَذَا الْأَمْرَ شَرٌّ لِي فِي دِينِي وَمَعَاشِي وَعَاقِبَةِ أَمْرِي فَاصْرِفْهُ عَنِّي وَاصْرِفْنِي عَنْهُ وَاقْدِرْ لِي الْخَيْرَ حَيْثُ كَانَ ثُمَّ أَرْضِنِي بِهِ
দোয়ার অনুবাদ
হে আল্লাহ, আমি আপনার ইলমের ওসিলা দিয়ে আপনার কাছে কল্যাণ প্রার্থনা করছি। আপনার কুদরতের ওসিলা দিয়ে আপনার কাছে কল্যাণমূলক কাজের সক্ষমতা প্রার্থনা করছি। আপনি গায়ব সম্পর্কে জ্ঞাত। হে আল্লাহ, আপনি সব জানেন আর আমি কিছুই জানি না। অর্থাৎ এ বিষয়টি আমার জন্য কল্যাণকর না অকল্যাণকর— সেই জ্ঞান আপনার আছে, কিন্তু আমার নেই। আপনার কুদরত রয়েছে আর আমার মধ্যে কোনো কুদরত-সক্ষমতা নেই। যদি আপনার ইলমে এটা থাকে যে, এই বিষয়টি (ওপরের প্রথম আন্ডারলাইন করা জায়গাটির অনুবাদ। এখানে কাঙ্ক্ষিত বিষয়টি কল্পনায় আনবে।) আমার জন্য কল্যাণকর, আমার দীনের জন্য কল্যাণকর, আমার জীবনধারা এবং দুনিয়ার জন্য কল্যাণকর এবং পরিণতির বিচারেও কল্যাণকর, তাহলে তা আমার জন্য নির্ধারিত করে দিন, আমার জন্য তা সহজ করে দিন এবং আমার জন্য তাতে বরকত সৃষ্টি করে দিন। আর যদি আপনার ইলমে এটা থাকে যে, এই বিষয়টি (ওপরের দ্বিতীয় আন্ডারলাইন করা জায়গাটির অনুবাদ। এখানে কাঙ্ক্ষিত বিষয়টি কল্পনায় আনবে।) আমার জন্য মন্দ, আমার দীনের জন্যও মন্দ, আমার জীবনধারা এবং দুনিয়ার জন্যও মন্দ, পরিণতির বিচারেও মন্দ, তাহলে আমার থেকে তা সরিয়ে দিন এবং আমাকেও তা থেকে সরিয়ে রাখুন আর আমার জন্য কল্যাণকর বিষয় নির্ধারিত করুন, তা যেখানেই হোক। আমার জন্য তা সহজ করে দিন এবং আমার জন্য তাতে বরকত সৃষ্টি করে দিন। অর্থাৎ এ বিষয়টি যদি আমার জন্য কল্যাণকর না হয়, তাহলে তা হটিয়ে দিন এবং তার স্থলে যা কল্যাণকর হবে, আমার জন্য তা নির্ধারিত করে দিন। এরপর আমাকে সে বিষয়টির প্রতি সন্তুষ্ট করে দিন এবং আমার অন্তর প্রশান্ত করে দিন।
দু রাকাত নামাজ পড়ার পরে এই দোয়া করে নিলেই ইসতিখারা হয়ে যায়।
ইসতিখারার কোনো সময় নির্ধারিত নেই
কেউ কেউ মনে করেন, ইসতিখারা সর্বদা রাতে শয্যাগ্রহণের সময়ই করতে হয়, কিবা এশার নামাজের পরেই করতে হয়। এমন কোনো কিছুই জরুরি নয়। বরং যখনই সুযোগ হয়, এই ইসতিখারা করে নেয়া যায়। না রাতের কোনো শর্ত আছে, আর না দিনের। না শয়নের কোনো শর্ত আছে, আর না জাগরণের।
স্বপ্ন দেখা জরুরি নয়
কারো কারো ধারণা, ইসতিখারা করার পরে কোনো স্বপ্ন দেখবো, স্বপ্নের মাধ্যমে আমাদেরকে অবগত করা হবে, এই কাজ করো অথবা তা করা থেকে বিরত থাকো। স্মরণ রাখবেন, স্বপ্ন দেখা কোনো জরুরি বিষয় নয়। স্বপ্নে অবশ্যই কোনো নির্দেশনা দেয়া হবে বা অন্তত কোনো একটা ইঙ্গিত দেয়া হবে— এটা আবশ্যক কিছু নয়। কখনো স্বপ্ন আসে আর কখনো তা আসে না।
ইসতিখারার ফলাফল
কোনো কোনো ব্যক্তিকে বলতে শোনা যায়, ইসতিখারা করার পরে মানুষের অন্তর একদিকে ঝুঁকে যায়। অন্তর যেদিকে ঝোঁকে, সে কাজের সিদ্ধান্তই নিতে হয়। হাঁ, অনেকসময়ই অন্তরে এই ঝোঁক সৃষ্টি হয়। কিন্তু তা কোনো জরুরি বিষয় নয়। একান্ত অন্তর কোনো দিকে যদি না ঝোঁকে, বরং তাতে দোদুল্যমানতা থেকেই যায়, তখনও ইসতিখারার উদ্দেশ্য অর্জিত হয়ে যায়। কেননা ইসতিখারা করার পরে আল্লাহ তাআলা বান্দার জন্য সে ফায়সালাই করে, যা তার জন্য কল্যাণকর। এরপর অবস্থাই এমন সৃষ্টি হয়ে যায় এবং তা-ই সংঘটিত হয়, যার মধ্যে বান্দার জন্য প্রভূত কল্যাণ লুকায়িত রয়েছে। প্রথম থেকে সে বিষয়ে তার ধারণাও থাকে না। কখনো মানুষ কোনো এক পথকে খুব উত্তম মনে করে, কিন্তু হঠাৎ দেখা যায়, সেই পথে অনেক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা বান্দাকে সেই পথ থেকে সরিয়ে নেন। ইসতিখারার পরে আল্লাহ তাআলা আসবাব-উপকরণগুলোকে এমনভাবে সৃষ্টি করে দেন, তখন তা-ই ঘটে, যার মধ্যে বান্দার জন্য কল্যাণ লুকায়িত রয়েছে। এখন কল্যাণ কিসের মাঝে? মানুষ তা জানে না, কিন্তু (ইসতিখারার মাধ্যমে) আল্লাহ তাআলা তার জন্য কলাণ নির্ধারিত করে দেন।
তোমার জন্য এটাই কল্যাণকর ছিলো
যখন সেই কাজটি হয়ে যায়, তখন কোনো কোনো সময় এমনটা মনে হয়, যা হয়েছে বাহ্যত তা মঙ্গলজনক মনে হচ্ছে না, অন্তরের দাবির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণও বোধ হচ্ছে না। এই অবস্থায় বান্দা আল্লাহ তাআলার কাছে অভিযোগ জানায়, হে আল্লাহ! আমি তো আপনার সঙ্গে মশওয়ারাহ ইসতিখারা করেছিলাম। কিন্তু কাজ তো তা-ই হলো, যা আমার মর্জি এবং তবিয়তের সম্পূর্ণ বিরোধী। যা হলো, বাহ্যত তা-তো মঙ্গলজনক মনে হচ্ছে না। এই প্রসঙ্গে আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. বলছেন, আরে বোকা! তুই তোর সীমাবদ্ধ বিবেক দ্বারা ভেবে নিয়েছিস, তোর জন্য এই বিষয়টি মঙ্গলজনক হয়নি। কিন্তু যার ইলমের অধীনে সমগ্র বিশ্বের পরিচালনার জ্ঞান, তিনি ভালো করেই জানেন, তোর জন্য কোনটা কল্যাণকর ছিলো আর কোনটা অকল্যাণকর ছিলো। তিনি যা করেছেন, তোর জন্য সেটাই কল্যাণকর ছিলো। কোনো কোনো সময় তো দুনিয়ায়ই জানা হয়ে যায়, আদতে কোনটা তোর জন্য কল্যাণকর ছিলো আর কখনোবা সারাটা জীবনে ফায়সালাকৃত বিষয়ের যথার্থতা বোধগম্য হয়ে ওঠে না। এরপর যখন আখিরাতে গমন করবি, তখন সেখানে গিয়ে বুঝতে পারবি, আদতে ফায়সালাকৃত বিষয়টিই তোর জন্য কল্যাণকর ছিলো।
তুমি শিশুর মতো
এর দৃষ্টান্ত এভাবে বোঝো। একটি শিশু আহ্লাদে লাফাচ্ছে। মা-বাবার কাছে বায়না ধরে বসেছে, আমি অমুক জিনিসটা খাবোই। মা-বাবা জানেন যে, এই অবস্থায় বাচ্চাকে তা খাওয়ানো হলে স্বাস্থ্যের বেশ ক্ষতি হবে। তখন মা-বাবা বাচ্চাকে সেই জিনিসটা খেতে দেয় না। এখন নির্বুদ্ধিতার কারণে বাচ্চা এটা বুঝে নেয়, আমার মা-বাবা আমার প্রতি জুলুম করেছে। আমি যে জিনিসটা এতো করে চাইলাম, আমাকে তা দিলো না। তার বদলে উল্টো বরং কী সব তিতা তিতা ওষুধ খাওয়াচ্ছে। সেই শিশুটি এখন ওষুধকে নিজের জন্য উত্তম মনে করছে না, কিন্তু বড় হওয়ার পর যখন আল্লাহ তাআলা তাকে আকল এবং বোধশক্তি দান করবেন এবং সঠিক বিষয়টি তার বোধগম্য হবে, তখন সে টের পাবে আর ভাববে, আমি তো নিজের জন্য মৃত্যুর বায়না ধরেছিলাম। আর আমার মা-বাবা আমার জন্য সুস্থ সুন্দর জীবনের পথ সন্ধান করছিলেন।
আল্লাহ তাআলা তো বান্দার ওপর মা-বাবার থেকেও অধিক মেহেরবান। এজন্য আল্লাহ তাআলা সে পথ নির্বাচন করেন, যার পরিণতি বান্দার জন্য কল্যাণকর হয়। এরপর কখনো তার যথার্থতা দুনিয়ায়ই বোধগম্য হয়ে যায় আর কখনোবা দুনিয়ার যিন্দেগিতে তা অবোধগোম্যই থেকে যায়।
Mohsin Molla
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন