জীবনে কেন বিপদাপদ ঘটে?
আজকের খুতবায়, ইনশাআল্লাহু তা’য়ালা, আমি আপনাদের সাথে আমাদের দ্বীন এর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধারণা প্রসঙ্গে বলব। যে সম্পর্কে কুর’আনে বহুবার বলা হয়েছে, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে, অন্ততঃ আমার জানা মতে, অবশ্যই আল্লাহ আযযা ওয়াযাল ভাল জানেন, আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, সাধারন মুসলিমরা বিশেষতঃ এই বিষয়টিতে বেশ বিভ্রান্ত(কনফিউজড), আর যে বিষয়টি কি না আমাদের ঈমানের সাথে সম্পৃক্ত। কেননা এটা আমাদের কথাবার্তায় চলে আসে এবং ব্যাপারটি নিয়ে অনেকেই অনেক কষ্ট পেয়ে থাকেন শুধুমাত্র ঠিকমত এ বিষয়টি না বোঝার কারণে।
আর তাই আজকের খুতবার বিষয়টি হলঃ
“কেন বিপদাপদ ঘটে? কেন (জীবনে) বিপদাপদ আসে?”
আর আমরা যদি এই বিষয়টিকে আমাদের ঈমানের অংশ হিসেবে না দেখি, তখন আমরা অনেক সময় বিপদগ্রস্ত কাউকে এমন কিছু বলে বসি, যা কি না তাকে আরও বেশী কষ্ট দেয়।
উদাহরণস্বরূপ, এইতো ক’দিন আগেই আমি কথা বলছিলাম আমার এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের সাথে। কথা হচ্ছিল আমাদের প্রয়াতঃ দাদীকে নিয়ে। উনি মারা গেছেন(আল্লাহ ওনাকে রহম করুক)। মারা যাওয়ার আগ দিয়ে উনি অনেক কষ্ট পেয়েছেন। তো আমাদের পরিবারেরই এক চাচাত ভাই(কাজিন)এর ধারণা হল, ওনার এই মৃত্যুকষ্ট পাওয়ার কারণ, উনি যখন অল্পবয়সের ছিলেন তখন কোন এক চাচী বা কারও একজনের সাথে ভীষণ খারাপ ব্যবহার করতেন! আর সেজন্যই আল্লাহ ওনাকে মারা যাওয়ার আগে এত কষ্টের ভেতর দিয়ে নিয়েছেন!
তারা এসব কথাচ্ছলে বলে। কথার কথায় বলে ফেলে। কিন্তু আসলে প্রথমতঃ এধরণের কথা খুবই বেদনাদায়ক, আর কাউকে নিয়ে এমন কথা বলা কতটুকু ন্যয়সঙ্গত যে আল্লাহ অমুক কারণে তাকে শাস্তি দিচ্ছেন, বিশেষত এমন কাউকে নিয়ে বলা যিনি ইতোমধ্যে মারা গিয়েছেন। সত্যি বলতে কী, আমি খেয়াল করে দেখলাম, আমাদের পারস্পরিক কথাবার্তায় আমরা অহরহ এধরণের কথা বলে থাকি একজন আরেকজনকে।
“জানো, কেন তোমার এমন হচ্ছে?? কারণ, আল্লাহ তোমার প্রতি নারাজ!”
এমনকী আমি বাবা-মাদেরকেও এধরনের কথা ব্যবহার করতে দেখেছি বাচ্চাদের সাথে।
“জানো, কেন তুমি সিঁড়ি থেকে পড়ে গেলে? কারণ কালকে যে তোমাকে নাস্তা শেষ করতে বলেছিলাম আর তুমি কর নাই, সেজন্য আল্লাহ তোমাকে শাস্তি দিলেন !! এজন্যই তুমি ব্যথা পেলে, কারন তুমি আমার কথা শোননি!”
স্বামী-স্ত্রী পরস্পর এধরনের কথা ব্যবহার করে আক্রমন করে একজন আরেকজনকে। একজন আরেকজনকে কথা শোনায়। আর এই বিষয়গুলো কি না আমাদের ঈমান এর সাথে সংশ্লিষ্ট!! আর তাই আমাদের কে একদম ঠিকমত, খুব ভালভাবে বুঝতে হবে বিষয়টি।
তো আমি যখন বলছি বিপদাপদ, আমি শুধুমাত্র ছোটখাট বিপদের কথা বলছিনা। আমি ছোট, বড় সবধরনের বিপদাপদ নিয়েই বলছি। আবার আমি শুধু সেসব ঘটনার কথাও বলছিনা যেগুলো আমাদের সাথে ব্যক্তিগতভাবে ঘটে থাকে। কারণ ব্যক্তিগতভাবে যেমন কারও, আল্লাহ না করুক, হয়ত একটা গাড়ি দূর্ঘটনা ঘটল, কারও হয়ত একটা দুরারোগ্য অসুখ ধরা পড়ল, কারও বা হয়ত প্রয়োজন পড়ল একটা অস্ত্রোপচার এর, কারও হয়ত নিজ পরিবারের কাছের মানুষ মারা গেল, কাউকে হয়ত শেষমেষ হাসপাতালে ভর্তি হতে হল, অথবা কেউ চাকরী হারাল এবং অর্থকষ্টে পতিত হল। অথবা কাউকে বাড়ি ছাড়তে হল, হয়ত বন্ধক করা ছিল যেটা বাজেয়াপ্ত হয়ে গেছে বা এরকমকিছু। এগুলো ছাড়াও আরও ব্যাপক পরিসরের ঝামেলা রয়েছে যেগুলোতে একটা সমাজ বা গোটা একটা শহর আক্রান্ত হয় , যেমন বন্যার কবলে পড়ল একটা শহর। আর পুরো শহরটা বিধ্বস্ত হয়ে গেল। একটা ভুমিকম্প হল, শতশত হাজার হাজার মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হল। অথবা দুই জাতির মধ্যে যুদ্ধ শুরু হল, কিংবা গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। আর যা কি না ছিল একটা শান্তিময় পরিবেশ, হঠাৎ তা পতিত হল আগুনের মুখে, সম্পূর্ণ পুড়ে ছারখার হয়ে গেল! একদিন আগেও যেমন ছিল, পরেরদিন আর আপনি সেই জায়গা চিনছেন না। কাজেই এরকম ঘটনা হতে পারে ব্যক্তিগত পর্যায়ের প্রাত্যহিক ব্যাপার, আবার হতে পারে আরও বৃহৎ পরিসরের। তো আমি শুরু করব ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে, আর সম্ভবত এই খুতবায় আসলে এই পর্যায়টি নিয়েই বলার সময় হবে। আর সেটা বেশ গুরুত্বপূর্ণও, কারণ আমাদের নিত্য-নৈমিত্তিক কথাবার্তাতেই, অন্যদের কথা বাদই দিলাম, আমি মুসলিমদেরকেই বলতে শুনেছি, আমার নিজ কানেই, আমরা গাড়ি চালাচ্ছি, কোন কারণে দেরী হয়ে গেছে, ব্যস বলে ফেললাম, “আল্লাহ মনে হয় আজকে আমার সাথে খুব খারাপ মেজাজে আছেন! এজন্য একেবারে শেষ করে দিচ্ছেন! জানিনা কী এমন করে ফেলেছি…আর আল্লাহ আমার উপর রাগ হয়ে গেলেন!” মানুষ এইভাবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালাকে নিয়েও কথা বলতে পারে! বুঝলেন? আপনি নিজে সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠেন নি, ভুল রাস্তায় গাড়ী উঠিয়েছেন…কেননা ঠিকমত খবরে শোনেননি যে এই রাস্তায় একটা দুর্ঘটনা আগেই হয়েছিল। আর এখন কি না, যা যা ঘটল তার সব দোষ আল্লাহ আযযাওয়াযাল এর!
এই প্রসঙ্গে বলব, প্রথমতঃ, এটা একটা বেশ জটিল বিষয়। দ্বিতীয়তঃ, এ ব্যাপারে কুর’আনে অসংখ্য আয়াত রয়েছে, ১/২টা নয়, আক্ষরিক অর্থেই ডজন খানেক আয়াত রয়েছে “আল-মুসিবাহ” এই বিষয়টির উপরেই। আল-মুসিবাহ…এটি আসলে কী, সে আলোচনায় আসছি, আমার মনে হয়, বাংলা/উর্দূ ভাষাভাষিগণ আন্দাজ করে নিয়েছেন শব্দটির মানে। যে এটা এক ধরনের দুর্যোগ, বা ভয়ানক কিছু ঘটে যাওয়া। আরবীতে আমরা মোটামুটি এরকম কাছাকাছি অর্থেই এই শব্দটি ব্যবহার করি। তবে প্রকৃতপক্ষে “মুসিবাহ” বলা হয় অনেক বড় মাপের বিপদ বা দুর্যোগ এর ক্ষেত্রে। কিন্তু পূর্ববর্তী আরবী ভাষায় আসলে, আগে চলুন শব্দটির সংজ্ঞা জেনে নেই।“মুসিবাহ” শব্দটি এসেছে আরবী ভাষার “আসাবা” ক্রিয়া থেকে। আর “আসাবা” হল কোন একটা লক্ষ্যবস্তু কে আঘাত করা। যখন আপনি একটি লক্ষ্যবস্তুকে একদম ঠিকমত আঘাত করতে পারবেন, তখন লক্ষ্যবস্তুতে এই আঘাত করাটা, এই জায়গামত আঘাত করাটাই হল “আসাব”। যার কারণে অন্য আরেকটি শব্দ “সঠিক” এর আরবী হল “সাওয়াব”/“সাহীহ”। সঠিক লক্ষ্যে আঘাত করার ক্রিয়াটি হচ্ছে “ইসাবা”। এখন “মুসিবা” শব্দটি হল, কিছু একটা যা আপনাকে আঘাত করে, আর আঘাতটা করে একেবারে জায়গামত এসে। সুতরাং প্রথমেই যেই জিনিসটা যা আমরা এই শব্দের প্রয়োগ হিসেবে শিখি আল্লাহ আযযা-ওয়াযাল এর কাছ থেকে, তা হল আমাদের অবস্থা বা আমাদের সাথে ঘটেছে এমন কিছুর বর্ননা দিতে গিয়ে, কোন একটা কিছু কারিসাহ ﻛﺎﺭﺛﺔ , হাদিসা ﺣﺪﺙ , ওয়াকিয়া ﻭَﺍﻗِﻌَﺔُ, আমাদের সাথে একটা কিছু খারাপ হয়েছে, একটা অঘটন ঘটেছে, কিন্তু আল্লাহ অন্য শব্দগুলো তেমন প্রয়োগ না করে বেশীরভাগ সময় “আল- মুসিবা” শব্দটিই ব্যবহার করে থাকেন। কেন? কেননা…আল্লাহ এটাই বুঝিয়ে দেন যে, যে পর্যন্ত তাঁর নির্ধারিত ক্বাদর(ভাগ্য) সম্পৃক্ত, যে পর্যন্ত তাঁর পরিকল্পনা জড়িত, ঘটে যাওয়া পুরো ব্যাপারটি তখন একটা ছুঁটে আসা তীরের মত, যেটা আপনাকে লক্ষ্য করেই ছোঁড়া হয়েছে আর এটা অবধারিতভাবে একদম আপনার গায়ে এসেই বিধঁবে, কখন, কোথায়, কীভাবে, কত গভীরে, কত খারাপভাবে এসে বিঁধবে সবকিছু নির্ধারিত হয়েই আছে। এটা একদম একটা নিখুঁত নিশানা ছিল। নিখুঁত। এরপর আবার শব্দটির শেষে রয়েছে তা’মারবুতা ( ﺓ), যারজন্য আমরা উচ্চারণ করি “মুসিবাহ”, “মুসিব” না কিন্তু। আর শব্দের শেষে এই তা’মারবুতা যোগ করে শব্দে “আল-হাদাস” ধারণাটিকে সংশ্লিষ্ট করা হয়, যার মানে হল প্রত্যেকটি ছোট ছোট ঘটনা বা প্রতিটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জিনিস। দেখুন আমি আপনি কিভাবে চিন্তা করি? (উদাহরণ) প্রথম যে জিনিসটা ঘটল তা হল, অফিসে যাওয়ার পথে আমার গাড়ী নষ্ট হয়ে গেল, এর ফলস্বরূপ, আমি মিটিং এ পৌঁছালাম দেরী করে। আর তারপর এই দেরীতে পৌঁছানোর জের ধরে আমার চাকরীটাই চলে গেল! আর তার ফল হল আমার বিবাহ-বিচ্ছেদ। এর থেকে এই ফল…তার থেকে সেই ফল…সেই থেকে আরেক ফল! এক ভাই এর সাথে একবার দেখা হল, খুব বেশিদিন আগের কথা না, তার পাসপোর্ট সংক্রান্ত কিছু ঝামেলা চলছিল, সেই ঝামেলার ফলে সে তার পাসপোর্টটি হারিয়ে ফেলে। তার ফলস্বরূপ সে চাকরী হারায়, আর সেই সূত্র ধরে তার বউ এর সাথে তার বাদানুবাদ ঘটে, সে তখন সবকিছুর জন্য দোষ দেয় ঐ পাসপোর্ট কোম্পানীকেই। অথবা ভিসার কাজ যে করছে সেই কোম্পানীকে! “তাদের কারনেই আজ আমি চাকরী হারিয়েছি, বউ হারিয়েছি, আমার সবকিছু হারিয়েছি!” এভাবে তারা সবকিছুকেই এক সুতায় গেঁথে ফেলে, কর্ম-কর্মফল, কর্ম-কর্মফল, কর্ম-কর্মফল!(কস এন্ড ইফেক্ট)। সবকিছুরই অবতারণা কি না কেবল ঐ একটি জিনিস থেকে। আর আমরাও কিন্তু এইগুলো থেকে মুক্ত নই। আল্লাহ-আযযা ওয়াযাল কিন্তু বলেছেন এই সমস্ত বিপদের মধ্যে যেই এক একটি বিপদ, এগুলো প্রত্যেকটি বিপদ পৃথক এবং একক। তাদের কোনটিই একে অপরের ফলস্বরুপ নয়, বরং তারা প্রত্যেকেই হল আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত প্রকল্পের ফল। আল্লাহ আযযা-ওয়াযালের ইচ্ছাতেই ঐ ঘটনা প্রবাহের প্রতিটি ঘটনা এক এক করে ঘটেছে। আবার এরকম অনেক মানুষই আছেন যাদের অবস্থা অনেকটা আপনার মতই, কিন্তু তাদের সাথে এমনটি হয় না! তাদের ঘটনা-প্রবাহ একরকম হয় না। আল্লাহ তাদের জন্য ভিন্ন কিছু নির্ধারণ করেছেন। তো তাহলে এটাই হল “আল-মুসিবাহ” শব্দটির প্রথম পাঠ/শিক্ষা যে বিপদটি সুনির্দিষ্টভাবে আপনার জন্যই ধার্য। দু’টো আয়াত, ডজনখানেকের মধ্যে অন্ততঃপক্ষে দুটো আয়াত রয়েছে যা কিনা কোন অবস্থাতেই আমাদের ভুলে যাওয়া উচিৎ নয়। “মুসিবাহ” শব্দটি প্রসঙ্গেই আল্লাহ তা’য়ালা সর্বপ্রথম বলেছেন, সূরাহ-বাকারা তে যে আয়াতগুলো তিলাওয়াত করেছিলাম আগেই,
ﻭَﺑَﺸِّﺮِ ﺍﻟﺼَّﺎﺑِﺮِﻳﻦَ
…অভিনন্দন জানাও ধৈর্য্যশীলদের। (সূরাহ বাকারাঃ ১৫৫)
কী অদ্ভুত সুন্দর ভাষাই না আল্লাহ আযযা-ওয়াযাল ব্যবহার করে থাকেন!! যখন আপনার কিংবা আমার কোন একটা কঠিন সময় এসে পড়ে, তখন আমাদের ধৈর্য ধারণ করা কর্তব্য। সুখের সময়ে তো ধৈর্যের প্রশ্ন আসে না, কিন্তু আপনার ধৈর্য ধারণের দরকার যখন কি না আপনি বিপর্যস্ত, যখন কিছু একটা সমস্যা হয়। যখন খারাপ কিছু ঘটে। আপনার গ্রাজুয়েশন করার কথা, আল্লাহ বিলম্বিত করলেন, আপনি একটা ক্লাসে পাস করতে পারলেন না। এখন আপনাকে কিছুটা ধৈর্য ধরতে হবে। আপনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন, আপনাকে ধৈর্য ধরতে হবে। যেকোন একটা খারাপ কিছু ঘটলেই আপনাকে ধৈর্য ধরতে হবে। এখন আপনারাই বলেন, আমি, আপনি…যখন নিজেরা নিজেরা কথা বলি, কেউ একজন হয়ত এমন একটা কঠিন অবস্থার সম্মুখীন হল যখন ধৈর্য ধরা ছাড়া পথ নাই, মনে করুন একই অবস্থায় আপনি আমি, আর সে মুহূর্তে আমাদের জন্য কি না একমাত্র একটাই পরামর্শ, তা হল ধৈর্য-ধারণ। এখন এ অবস্থায় কেউ কি গিয়ে ওই ব্যক্তিকে বলবে যে, “আপনাকে অভিনন্দন”?! দেখুন…এর কী কোন মানে হয়? কিছুই তো বোঝা যাচ্ছে না!!
“ভাই, আমার খুবই খারাপ লাগছে আপনার এই দুঃসময়ে, দু’আ করি আল্লাহ আপনাকে আরও ধৈর্য দান করুক।” আপনি এ অবস্থার কারও সাথে হেসে হেসে কথা বলেন না, বা তাকে অভিনন্দনও জানান না। আপনি সাধারণত কখন কাউকে অভিনন্দন জানান? যখন কি না তার একটা খুশির কিছু ঘটে, যখন কি না সবকিছু তার পরিকল্পনা অনুযায়ী সংঘটিত হয়। কেউ তার পছন্দের চাকরিটা পেয়ে যায়, কারও পদোন্নতি হয়, বেতন বেড়ে যায় অথবা কেউ বিয়ে করার কথা ভাবছে, পছন্দমত সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যায় এমন আনন্দের মুহূর্তগুলোতেই আমরা অন্যদের অভিনন্দন জানাই।
অথচ আল্লাহ পাক কি বলছেন! তিনি বলছেন, যারা ধৈর্য ধরে আছে, তাদের অভিনন্দন জানাও! সুবহানআল্লাহ। কেন? কারণ একজন মুমিনের আচরণই হবে আলাদা।
হয়তো যেই বিপদের মাঝে দিয়ে আপনি যাচ্ছেন, পুরো ঘটনাটার উদ্দেশ্য একটাই। যাতে আপনি ধৈর্য ধরতে পারেন। আর যদি আপনি ধৈর্য ধরতে পারেন, তখনই আপনি অভিনন্দন পাবার যোগ্য।
আমরা ভাবি আমাদের লক্ষ্য এই দুনিয়ার একটি বিশেষ জিনিস পাওয়া। হয়তো আমার লক্ষ্য ঐ চাকরিটা পাওয়া অথবা কিছু বিক্রি করা কিন্তু হয়তো আল্লাহ পাকের কাছে সত্যিকারের লক্ষ্য হল যে আমরা ধৈর্য ধরতে শিখব। এটা আর সব লক্ষ্যের চেয়ে বড়। সুবহানআল্লাহ! আর যদি আপনি ঐ লক্ষ্যে পৌঁছে যান, তাহলেই আপনিই অভিনন্দন পাবার যোগ্য!
আমাদের মনে নানা ধরনের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য আছে, যা আমরা মনে করি আমাদের বাস্তবায়ন করতে হবে। অথচ আল্লাহ বলেন, এর চেয়েও অনেক মূল্যবান কিছু তোমাদের মনে আছে, যদি তোমরা তা বাস্তবায়ন করতে পার- যদিও এর মূল্য তোমরা অনুধাবন করতে পার না, তবে আমি তোমাদের জানাচ্ছি এর মূল্য কতখানি! – এর মূল্য হলো এটা অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য।
আর ঠিক এরপরেই, এই অভিনন্দন জানানোর পরই আল্লাহ পাক বলেন
ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﺇِﺫَﺍ ﺃَﺻَﺎﺑَﺘْﻬُﻢ ﻣُّﺼِﻴﺒَﺔٌ ﻗَﺎﻟُﻮﺍ ﺇِﻧَّﺎ ﻟِﻠَّﻪِ ﻭَﺇِﻧَّﺎ ﺇِﻟَﻴْﻪِ ﺭَﺍﺟِﻌُﻮ
” যখন তারা বিপদে পতিত হয়, তখন বলে, নিশ্চয় আমরা সবাই আল্লাহর জন্য এবং আমরা সবাই তাঁরই সান্নিধ্যে ফিরে যাবো।” (সূরা বাকারাঃ ১৫৬)
কোন ধৈর্যশীল ব্যক্তিদের জন্য এই অভিনন্দন? যখনই একটি নির্দিষ্ট বিপর্যয় তাদের আঘাত করে , যে কথাটি প্রথমেই তাদের মুখে চলে আসে –‘কালু’ (তারা বলে) , এমনকি ‘ফাক্বালু’ও (অতপর তারা বলে ) নয়। এমনকি ‘ছুম্মা ক্বালু’ ও (এরপর তারা বলে) নয়। আল্লাহ পাক বলছেন না যে, তখন তারা বলে। যদি এটা ঘটে বা যখন ঘটে তখন তারা বলে। বাক্যটিতে কোন “যদি” নেই, এমনকি “তখন” কথাটিও নেই। কেন নেই? কারণ এটা হতে হবে একটি তাৎক্ষণিক জবাব!
আমরা ফিজিক্স , মেডিসিন অথবা বায়োলজিতে পড়ে থাকতে পারি, ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে। যখন একজন ডাক্তার আমাদের শারীরিক প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে তখন সে হাটুতে হালকা আঘাত করে এবং হাটু তাৎক্ষণিকভাবেই একটু উপরে উঠে যায়। তারা এই রিফ্লেক্সগুলোকে পরীক্ষা করে। এই আয়াতটি আমাদের এটাই শিখাতে চাচ্ছে যে, যখন যাবতীয় বিপদ-আপদ আপনার আমার উপর আসবে, আমাদের একটি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিত। প্রতিক্রিয়া কখনই দেরিতে হয়না, সঙ্গে সঙ্গেই হয়ে যায়। কাউকে জোর করে করতে হয়না, এমনিতেই চলে আসে। আর কী চলে আসে ? “ইন্না লিল্লাহি” কোন সন্দেহ নেই, আমরা আল্লাহ্রই জন্য। “ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন” এবং আমরা একমাত্র তার কাছেই ফিরে যাব। অর্থাৎ আমাদেরকে আমাদের মালিকের কাছেই ফিরিয়ে দেয়া হবে।
বিপর্যয়ের সময় এই আয়াতটি কেন গুরুত্বপূর্ণ ? আমাদেরকে এর হিকমা সম্পর্কে ভাবতে হবে যে যখনই কোন বিপদ আপদ আসে, কেন আমরা “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন” বলব? যখন আপনি ফোনে কোন খারাপ খবর শুনলেন, কেন আপনি সঙ্গে সঙ্গে বলেন “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন”? এখন প্রথমে বুঝতে চেষ্টা করুন যে, আপনি যদি এটা বলেন তাহলে কুরআন আপনার জন্য একটি পুরস্কার বরাদ্দ রেখেছে। কুরআনে আপনার জন্য একটি পুরস্কার রয়েছে। প্রথমে আমি আপনাদের সাথে সেই পুরস্কারটি শেয়ার করতে চাই। কি সেই পুরস্কার?
ঠিক আগের আয়াতটিতে আল্লাহ আদেশ করেছিলেন মুমিনদেরকে অভিনন্দন জানাতে। এখানে আদেশটি হলো : ‘আল আমর ফিল মুফরাদ’। এখানে বহুবচন ﻭﺑﺸﺮﻭﺍ ﺍﻟﺼﺎﺑﺮﻳﻦ বলা হয়নি বরং বলা হয়েছে ﻭﺑﺸﺮ ﺍﻟﺼﺎﺑﺮﻳﻦ যা একবচন। এখানে আদেশটি একবচনে ব্যবহৃত হয়েছে। আর যখন আল্লাহ পাক শুধু একজনকে আদেশ করছেন, তখন এটি আমাদের নবী (সা) এর উপর সরাসরি আদেশ। অর্থাৎ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তার নিজের মুখ থেকেই ধৈর্যশীলদের অভিনন্দন জানাবেন। আর এর পরের আয়াতটিতে তিনি বলছেন যে, যারা “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন” বলছে বিপদের সময়ে (আল্লাহ পাক আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করুন), যখন আমরা কেয়ামতের দিনে দাঁড়িয়ে থাকব, আমরা যেন তাদের অন্তর্ভুক্ত হই যাদের রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে অভিনন্দন জানাবেন! এই আয়াতটি এটাই বলছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে তাদেরকে অভিনন্দন জানাবেন যারা এই কাজটি করবে। আর আমরা অবশ্যই তাঁর কাছে থেকে অভিনন্দন পেতে চাই। যখন আমাদের পরিবার আমাদের অভিনন্দন জানায় তখন আমাদের এক ধরনের অনুভূতি হয়, আবার যখন স্কুলের প্রিন্সিপাল অভিনন্দন জানায় তখন আমাদের ভিন্ন অনুভূতি হয়, যখন ভার্সিটির ডিন আমাদের অভ্যর্থনা জানায় তখন আবার অন্য রকম এক অনুভূতি।আর যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওই ধৈর্যশীলদের অভ্যর্থনা জানাবেন, আল্লাহ পাক তাঁকে আদেশ করেছেন তাদের অভিনন্দন জানাবার জন্য, আমরা অবশ্যই তাদের মাঝে একজন হতে চাই। এটাই সেই পুরস্কার।
এখন আমরা “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন” এ ফিরে যাই। কিছু উদাহরণ দেয়া যাক। আমি জানি, আপনাদের কারও কারও সমস্যা হয়ত এর চেয়ে আরও অনেক অনেক বড়, এটা শুধু আমি একটি উদাহরণস্বরূপ দিচ্ছি আমার কল্পনা থেকে। আপনারা নিজেদের ব্যাপারেই ভাবুন এই উদাহরণ গুলোর পরিপ্রেক্ষিতে। ধরুন আমি একটি প্রাইভেট কার ড্রাইভ করছি। একদম নতুন কেনা। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই গাড়িতে কোন একটা সমস্যা দেখা গেল। বাধ্য হয়ে গাড়িটা সাইড করে রাস্তার পাশে রাখতে হল। প্রচন্ড রাগ হল আমার, অনেকগুলো টাকা দিয়ে গাড়িটা কিনলাম। কিভাবে হতে পারে এমন কিছু? জরুরি কাজটা আজ মিস হয়ে যাচ্ছে। এই গরমে জ্যামের মাঝে আটকে আছি, ওইদিকে এসিটাও ঠিকভাবে কাজ করছেনা। এই সবকিছু নিজের মনে ভাবছি।
কিন্তু একজন সত্যিকারের মুমিন হিসেবে যেটা ভাবা উচিত, তা হল “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন”। কেন? কারণ আমি নিজেকে মনে করিয়ে দিচ্ছি, গাড়িটার উপর আমি বিরক্ত কারণ আমিই এটার মালিক। গাড়িটা আমারই। কিন্তু আমি নিজেকে মনে করিয়ে দিচ্ছি যে আমি আসলে কিছুরই মালিক নই, কোন কিছুই আমার সম্পদ নয়। বরং আমি নিজেই অন্য কারও সম্পত্তি। আমি একমাত্র আল্লাহর, তিনিই আমার মালিক। কোন সন্দেহ নেই, আমি তাঁরই জন্য। কিভাবে আমি তাহলে অভিযোগ করবো কিছুর ব্যাপারে? আমিতো কিছুরই মালিক নই!
মানুষ তখনই রেগে যায় যখন সে তার প্রাপ্য কিছু আশা করে, যখন আমার কিছু পাওয়ার কথা, পাওয়া উচিত। যখন আমাদের ফোন ঠিকভাবে কাজ করেনা, গাড়িটা ঠিকভাবে কাজ করেনা, লাইটটা অন হচ্ছে না। যখন প্রাপ্য কিছু আমরা না পাই, তখনই আমরা রেগে যাই। অথচ এই আয়াতটিতে আমরা বলি, “ইন্না লিল্লাহ”(আমরা আল্লাহর জন্য)। আমরা মেনে নেই, যে আসলে আমাদের প্রাপ্য বলতে কিছুই নেই। আমি তো আল্লাহরই জন্য, তিনি আমার মালিক। সবকিছু তাঁর প্রাপ্য, আমার নয়। এটি সব কিছুকে শান্ত করে দেয়। তখন এই দুনিয়ায় আমরা যাই পাই, সবকিছুই উপহারস্বরূপ। এমন কিছু নয় যা আমরা অর্জন করি , বরং উপহারমাত্র। আর যখন কিছু পাইনা, তখন বুঝতে পারি যে আরে এটাতো আমার প্রাপ্যই নয়।
আমরা আমাদের হাতকে খুব স্বাভাবিক কিছু বলে মনে করে নেই, আমাদের চোখকেও তেমনি স্বাভাবিক কিছুই মনে করি, আমাদের নাককেও খুব স্বাভাবিক কিছু মনে করি, আমাদের জিহবাকে খুব স্বাভাবিক কিছু মনে করি। আমি যে আপনাদের সামনে দাড়িয়ে কথা বলছি, আমি যে আপনাদের সাথে কথা বলতে পারছি এই সব কিছুকেই আমরা একদম স্বাভাবিক কিছুই মনে করি। কিন্তু এই জিহবার মালিক তো আমি নই। আমি তো কাউকে এই জন্য কোন টাকা দেইনি। একমাত্র আল্লাহ পাকই এটার মালিক। তাই যদি কখনও তোতলামি চলে আসে, “ইন্না লিল্লাহ”।
আর এই সমস্যাটার দ্বিতীয় অংশ, আল্লাহ পাক কিভাবে আমাদের ধর্মে সকল সমস্যার সমাধান দেন। কী জ্ঞানগর্ভ নির্দেশনাই না তিনি দান করেন!! যখন আমরা বিপদে পড়ি। দ্বিতীয় অংশ হল “ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন”। কোন সন্দেহ নেই, তার কাছেই আমরা ফিরে যাব। কেন এটা গুরুত্বপূর্ণ? কারণ আমি আপনি এই মুহূর্তে যেই বিপদেই থাকি না কেন, সেটা চিরস্থায়ী নয়! হোক সেটা টাকা পয়সার সমস্যা, স্বাস্থ্যগত সমস্যা, পরিবার নিয়ে সমস্যা, ইমোশনাল সমস্যা, শারীরিক সমস্যা, যেটাই হোক। কোনটাই চিরস্থায়ী নয়। কারণ আমি,আপনি,আমরা নিজেরাই চিরস্থায়ী নই। যখন আমরাই স্থায়ী নই, তাহলে আমাদের সমস্যাগুলো কিভাবে স্থায়ী হবে? আমাদের নিজেদেরই আল্লাহ পাকের কাছে ফিরে যেতে হবে। এই সমস্যাটা কিছুই নয়, বরং ভুলে যান এটি, কারণ আমরাই তো থাকবনা। শুধু যে এই ঝামেলাগুলো থাকবে না তা নয়, আমরাই থাকব না। আমাদেরই ফিরে যেতে হবে আল্লাহ পাকের কাছে।
সবকিছু সঠিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করুন । আর তখনই আপনি বুঝতে পারবেন আসলে আপনার কি নিয়ে চিন্তা করা উচিত। সার্বিক দিক থেকে সবকিছু বিচার না করলে যেকোন ভুল ব্যাপারে আপনি মনোনিবেশ করতে পারেন। আমার শিক্ষক সবসময় এই উদাহরণটি দিতেন যে, যদি কোন একটি বিল্ডিঙের ভিতরে থাকেন, যদি সেখানে আগুন লাগে, আর তখন আপনি কারও সাথে ঝগড়া করছেন কোন দেয়ালে কোন রঙ করা যায় তা নিয়ে?? ”আমার মনে হয় নীল রংটাই ভালো লাগছে।” জনাব! বিল্ডিঙে আগুন লেগেছে! আমাদের এখন সবার আগে পানি দরকার। আগুন নিভাতে হবে। এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে।
যখন আমরা পুরো প্রেক্ষাপটটা বুঝব যে আরও বড় সমস্যা আছে। আর সেই সমস্যাটি হল যে আমরা এখনো মেনে নেইনি যে আমরা আল্লাহ পাকের জন্য। হয়তো কখনও কখনও আমি আপনি কোন সমস্যার মাঝে দিয়ে এইজন্যই যাই যাতে আল্লাহ পাক আমাদের মনে করিয়ে দিতে পারেন যে আমি-আপনি- আমরা সবাই আল্লাহ পাকেরই জন্য। হয়তো আমি আপনি কোন বিপদের মাঝে দিয়ে যাচ্ছি এইজন্যই যে আল্লাহ পাক আমাদেরকে সেই পুরস্কারটি দিতে পারেন যে আমরা শুধু জিহবা দিয়ে বলব না বরং আমরা মন থেকেই বলতে পারব “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন”। শুধু এটাই অনেক বড় এক পুরস্কার। এটা যদি আমরা মনে গেঁথে নিতে পারি, তবে ধৈর্য ধরা তখন সহজ হয়ে যায়। আর যদি আমি আপনি ধৈর্য ধরতে পারি, (আল্লাহ আমাদের ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত করুন।) তবেই আমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অভ্যর্থনা পাব।
এটা ছিল দু’টো আয়াতের একটি যে ব্যাপারে আমি কথা বলতে চেয়েছিলাম। বিপদের প্রতি আমাদের প্রতিক্রিয়া হল- “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না লিল্লাহি রাজিউন”। কিন্তু এখন শেষ কিছু মিনিটে আমি অন্য একটা বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাই, জীবনে যত বিপদ আপদ, সমস্যা, চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয় সেগুলো নিয়ে।
আর সেটা হল কুরআনে দুই ধরনের আয়াত আছে। এক ধরণের আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন যে যা কিছুই তোমাদের ক্ষেত্রে ঘটে
ﻣَﺎ ﺃَﺻَﺎﺏَ ﻣِﻦ ﻣُّﺼِﻴﺒَﺔٍ ﻓِﻲ ﺍﻟْﺄَﺭْﺽِ ﻭَﻟَﺎ ﻓِﻲ ﺃَﻧﻔُﺴِﻜُﻢْ ﺇِﻟَّﺎ ﻓِﻲ ﻛِﺘَﺎﺏٍ ﻣِّﻦ ﻗَﺒْﻞِ ﺃَﻥ ﻧَّﺒْﺮَﺃَﻫَﺎ
‘’পৃথিবীতে এবং ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের উপর কোন বিপদ আসে না; কিন্তু তা জগত সৃষ্টির পূর্বেই কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে।‘’( সূরা হাদিদ -২২)
জীবনে যত রকম বিপদ হয়, যেখানেই হোক, যার উপরেই হোক, এমন কোন বিপদ নেই আকাশে মাটিতে যেখানেই হোক, যেটা আগে থেকেই কিতাবে লেখা নেই। এটা পূর্ব নির্ধারিত। অর্থাৎ এটি আল্লাহ পাকের কদর, যে এটা হবেই, হবারই ছিল। ধরুন কেউ একজন খুব অল্প বয়সে মারা গেল, আপনি এটা বলতে পারেন না যে আহা বেচারার পুরো জীবনটা সামনে পড়ে ছিল। না, তার ছিল না। এই রকম কিছুর অস্তিত্ত নেই। তার জীবনটা ওইটুকুই নির্ধারিত ছিল। এই দুনিয়াতে তার সময় ওইটুকুই ছিল, বেশিও নয়, কম ও নয়। আমার এই দুনিয়াতে থাকার সময়ও নির্ধারিত, আপনার সময়ও নির্ধারিত। আপনি বিভিন্ন কবরস্থানে গেলে দেখবেন যে কারও কারও জন্ম ১৯০১ সালে, মারা গেল ২০১৩ সালে। আবার এটাও দেখবেন যে কেউ জন্ম নিল ২০১৩, আবার মারাও গেল ২০১৩ সালে। এমন কবরও আপনি পাবেন। আর এটা আল্লাহ পাক আগেই নির্ধারণ করে রেখেছেন যে কতটুকু সময় আমরা প্রত্যেকে এই দুনিয়াতে থাকব। এটা নির্ধারিত।আপনি বলতে পারেন না যে আজ যদি সে বেঁচে থাকতো !না, না, না । কারণ এটা ঠিক করা ছিল, আগে থেকেই!
আরেকটি ব্যাপার আল্লাহ পাক বলেন যে,
ﻣَﺎ ﺃَﺻَﺎﺏَ ﻣِﻦ ﻣُّﺼِﻴﺒَﺔٍ ﺇِﻟَّﺎ ﺑِﺈِﺫْﻥِ ﺍﻟﻠَّﻪِ
“আল্লাহ পাকের অনুমতি ব্যতীত কোন বিপদ আপদ তোমাদের উপর পড়ে না” (সূরা তাঘাবুন-১১)
আর সত্যিকারের ঈমানদারদের দিকে তাকান, তারা কি দারুন কথাই না বলে! তারা বলেঃ
ﻗُﻞ ﻟَّﻦ ﻳُﺼِﻴﺒَﻨَﺎ ﺇِﻟَّﺎ ﻣَﺎ ﻛَﺘَﺐَ ﺍﻟﻠَّﻪُ ﻟَﻨَﺎ ﻫُﻮَ ﻣَﻮْﻟَﺎﻧَﺎ
“আপনি বলুন, আমাদের কাছে কিছুই পৌঁছবে না, কিন্তু যা আল্লাহ আমাদের জন্য রেখেছেন; তিনি আমাদের কার্যনির্বাহক। (সূরা আত-তাওবা ৫১)
আমাদের উপর কোন বিপদ আপতিত হয় না তা ব্যতীত যা আল্লাহ আমাদের জন্য লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। তারা বলতে পারতো যে যা আল্লাহ পাক আমাদের বিপক্ষে লিখে রেখেছেন। কারণ আমরা যখন বিপদ-আপদের কথা ভাবি, আমরা ভাবি এইগুলো সব আমাদের বিরুদ্ধে আসছে। কিন্তু আয়াতটি বলছে, ﻣَﺎ ﻛَﺘَﺐَ ﺍﻟﻠَّﻪُ ﻟَﻨَﺎ আমাদের জন্য যা লিখে রেখেছেন! ﻫُﻮَ ﻣَﻮْﻟَﺎﻧَﺎ আল্লাহই আমাদের অভিভাবক ও কার্যনির্বাহক। সুবহানাল্লাহ! আল্লাহ পাক বিশ্বাসীদের শেখাচ্ছেন যে যখন বিপদ-আপদ আসে এগুলো আমাদের বিরুদ্ধে লেখা নয়, বরং আমাদের জন্যই লেখা ! আর এইভাবেই একজন বিশ্বাসীকে ভাবতে হবে বিপদ-আপদ নিয়ে, যে এটা তার জন্যই।
পবিত্র কুরআনে আরও কিছু আয়াত আছে, একটি দুটি নয়, কয়েকটি। যেখানে আল্লাহ বলেন- তোমাদের উপর যা-ই ঘটে,
ﻓَﺄَﺻَﺎﺑَﻬُﻢْ ﺳَﻴِّﺌَﺎﺕُ ﻣَﺎ ﻋَﻤِﻠُﻮﺍ সুতরাং তাদের মন্দ কাজের শাস্তি তাদেরই মাথায় আপতিত হয়েছে। (সূরা নাহল: ৩৪)
ﻭَﻣَﺎ ﺃَﺻَﺎﺑَﻜُﻢ ﻣِّﻦ ﻣُّﺼِﻴﺒَﺔٍ ﻓَﺒِﻤَﺎ ﻛَﺴَﺒَﺖْ ﺃَﻳْﺪِﻳﻜُﻢْ ﻭَﻳَﻌْﻔُﻮ ﻋَﻦ ﻛَﺜِﻴﺮٍ
তোমাদের উপর যেসব বিপদ-আপদ পতিত হয়, তা তোমাদের কর্মেরই ফল এবং তিনি তোমাদের অনেক গোনাহ ক্ষমা করে দেন। (সূরা আশ শুরা:৩০)
আল্লাহ বলছেন এটা তোমাদের দোষ। কিছু আয়াতে আল্লাহ পাক এটাই বলছেন যে এটা আল্লাহর সিদ্ধান্তের কারণে নয় বরং তোমাদের নিজেদের কারণেই তোমাদের উপর বিপদাপদ পতিত হয়। এটা তোমাদের দোষ। তিনি অনেক গুনাহ ক্ষমা করে দেন।
এখন এই দুটো ব্যাপারে আমারা কিভাবে সিদ্ধান্তে আসব যে আসলে এটা কেন হল? আল্লাহ পাকের ইচ্ছায় নাকি আমার দোষে? প্রথম যে উপদেশটি আমি দিব- আল্লাহ পাক কখনই বলেননি, “কুল”(বল) বল, এটা তোমারদেরই দোষ। শুধুমাত্র সূরা আলি ইমরানের এক আয়াত ছাড়া,
ﻗُﻞْ ﻫُﻮَ ﻣِﻦْ ﻋِﻨﺪِ ﺃَﻧﻔُﺴِﻜُﻢْ
“এ কষ্ট তোমাদের উপর পৌঁছেছে তোমাদেরই পক্ষ থেকে।‘’ (৩: ১৬৫)
অন্য কথায়, আমরা এটা কখনই কাউকে বলতে পারব না যে এইরকম কিছু তোমার সাথে হচ্ছে, এটা তোমার দোষ। কেউ ক্যান্সারে আক্রান্ত, তাকে গিয়ে এটা বলতে পারব না যে, জানো তোমার কেন ক্যান্সার হয়েছে? কারণ তুমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড় না, এই জন্যই তোমার ক্যান্সার হয়েছে। এটা আপনি বলতে পারবেন না।
আবার অন্যদিকে, উহুদের যুদ্ধে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলা হয়েছিল তাদের বল যে, এটা তোমাদেরই ভুলের কারণে। যখন বিশ্বাসীরা জিজ্ঞেস করল, কেন এরকম হল, কিভাবে হল? তাদের বল, তোমাদেরই কারণে। এই ব্যতিক্রমের কারণ (তথা মানুষকে বলা যে, তোমাদের কারণেই তোমাদের উপর বিপদ আপতিত হয়েছে) হল উহুদের যুদ্ধের ক্ষেত্রে কী হয়েছিল? বিশ্বাসীরা জয়ের মুখ দেখেছিল, তারা প্রায় জিতে গিয়েছিল। তারা সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল আর শত্রু পক্ষ পালিয়ে যাচ্ছিল। তখনই কিছু তীরন্দাজরা তাদের নির্ধারিত স্থান ফেলে চলে গিয়েছিল। এর কারণে যুদ্ধের মোড় ঘুরে গিয়েছিল। এখন আপনারা তো আল্লাহ পাককে দোষ দিতে পারেন না । কারণ আপনারা একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত স্থান থেকে সরে গিয়েছিলেন! আপনাদের কাজ কর্মের জন্য আপনাদেরই দায়িত্ব নিতে হবে।
এই আয়াত থেকে আমরা এটাই শিখছি যে, সব কিছুতেই আল্লাহ পাকের দোহাই দিলে চলবে না। আপনি স্পিড লিমিট অতিক্রম করে গাড়ি চালাচ্ছিলেন, এরপর আপনি দুর্ঘটনায় পতিত হলেন, তখন আপনি বলেন, না এটা আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল, আল্লাহ পাকের ইচ্ছায়ই এটা হল। না না, সেটা কোন ভাবেই মেনে নেয়া যাবেনা। আপনি স্পিড অতিক্রম করেছেন, আপনি উম্মাদের মত গাড়ি চালাচ্ছিলেন, তাই এটা আপনারই দোষ। আপনার হয়তো গাড়িতে তেল ভরার কথা ছিল, কিন্তু আপনি ভরলেন ঘি অথবা অন্য কিছু :)। আপনার গাড়ি আর চলছে না, তখন আপনি বলছেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। আমি কি করতে পারি? না না, এটা আপনার কর্মেরই ফল, তাই আপনাকেই এই দায়িত্ব নিতে হবে।
সবকিছুতে আল্লাহ পাকের দোহাই দিলে চলবে না। আপনি নিজে কোন চাকরির জন্য আবেদন করছেন না, সারাদিন বাসায় বসে আছেন, আপনি কোন চাকরি পাচ্ছেন না, আল্লাহ পাক কোন ফেরেস্তাকে অফার লেটারসহ পাঠাচ্ছেন না আপনার কাছে । আর আপনি বলছেন আল্লাহ পাক যখন চাইবে, তখনই হবে, ততোক্ষণ পর্যন্ত, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন! না! কুরআনে এভাবেই ভারসাম্য রক্ষা করা হয়েছে।
যখন এমন কোন ঘটনা ঘটে, যেটি আপনার নিয়ন্ত্রনের বাইরে, সেটি আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকেই এসেছে। বন্যার আক্রমণ আপনার নিয়ন্ত্রনের বাইরে, কারও গাড়ি আপনাকে এসে ধাক্কা দিল, এটা আপনার নিয়ন্ত্রনের বাইরে। আপনার কোন গুরুতর অসুস্থতা ধরা পড়লো, এটি আপনার নিয়ন্ত্রনের বাইরে।
কিন্তু এই অসুস্থ হবার কারণ যদি হয় আপনার দিনে চার প্যাকেট সিগারেট খাওয়া। আপনার ডাক্তার বলে যে, আপনি কিন্তু ডায়াবেটিসের দিকে যাচ্ছেন। আর আপনি আপনার চিনিতে একটু চা ঢালেন। (অতিরিক্ত চিনি খাওয়া বুঝাতে তিনি ব্যাঙ্গ করে এটা বলেছেন) আপনি এইরকম যদি করেন, তাহলে আল্লাহ পাককে দোষারোপ করতে পারেন না ! এটা ﻣﻦ ﻋِﻨﺪِ ﺃَﻧﻔُﺴِﻜُﻢْ আপনারই দোষ! কুরআন এই সমস্যাকে কী চমৎকার ভারসাম্যপূর্ণ ভাবেই না বর্ণনা করেছে! বিশ্বাসীদের এটা বুঝতে হবে, কি করে দায়িত্ব নিতে হয়, নিজের কর্মফলের।
তবে যেটাই হোক, বিপদ যে কারনেই আসুক, যদি সেটা মৃত্যু না হয়, এটা আল্লাহ পাকের কাছ থেকে একটি পুরস্কার যেন আমরা শিক্ষা নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে পারি আর ভবিষ্যতে আরও ভাল কিছু করি। কিছু মানুষ তাদের চাকরি হারায়। আর তাদের মাঝে দুই ধরণের মানুষ আছে, কেউ নিজেকেই দোষারোপ করে, কেউ আবার আল্লাহ পাককে দোষারোপ করে।(না’উজুবিল্লাহ) কখনও কখনও এটা রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারনে হতে পারে। কিন্তু আপনি যদি প্রতিদিন দেরি করে অফিসে আসেন, আপনার কাজ আপনি শেষ করছেন না, আপনি যোগাযোগ ঠিকমত রাখছেন না, প্রতিদিন ৩০ টা ই-মেইল আসছে, আপনি সেগুলোর জবাব দিচ্ছেন না। তারপর আপনি বরখাস্ত হলেন, তখন আল্লাহ পাককে দোষারোপ করলে চলবে না। আপনার চাকরি যাওয়ারই ছিল। আর যখন আপনি বরখাস্ত হলেন, এটি আল্লাহ পাকের তরফ থেকে একটি পুরস্কার কারণ, পরের বার আপনি যখন চাকরি করবেন আপনি আগের বারের মত ওই ভুলগুলো আর করবেন না। শিক্ষা আপনি নিয়ে নিবেন। এই বিপদ আপদ গুলো আমাদের আগের চেয়ে ভালো মানুষে পরিনত করে, ভালো বিশ্বাসীতে, মানসিকভাবে আমাদের আরও শক্ত করে, আরও দায়িত্ববান করে।
এখন পুরোটার একটা সারমর্ম এই শেষ কিছু মিনিটে। প্রথমত, যখনই কোন বিপদ-আপদ আসবে, আপনার জবানকে শিক্ষা দিন, যেন সে এটা বলে, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। দ্বিতীয়ত, অন্য কাউকে এটা বলবেন না যে তারা এই বিপদে পড়েছে আল্লাহ পাকের কারনেই। কাউকে এমন কিছু বলবেন না। আপনি যদি কাউকে এগুলো বলতে চান, কারও কথা ভাবার আগে নিজের কথা ভাবুন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন